আমার মা সব কিছুতেই একটু বেশি বেশি দুশ্চিন্তা করেন। নিজে অস্থির হয়ে পড়েন এবং ক্রমশ সেই অস্থিরতাকে অতি দক্ষতার সাথে আশেপাশে অন্যান্যদের মাঝে সংকক্রমিত করেন। তার বড় মেয়ে হওয়ার দরুন এই দু’টো গুণ আমার মধ্যে চমৎকার ভাবে গেড়ে বসেছে। খুব ছোটখাট সমস্যাতেও অতি মাত্রায় অস্থির হয়ে পড়ি আমি।
ইদানিং আমার অতি আদরের একমাত্র ছোট্ট বোন তাসনিন সুলতানা নীলাকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি। বেশ ক’দিন ধরে কোন কাজেই ভালো করে মন বসাতে পারছি না। শরীর-মন কোনটাই ভালো নেই। অবশ্যি এবারের সমস্যটি এতো ছোটখাটও নয়। নীলা এবার সপ্তমশ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণীতে উঠতে যাচ্ছে এবং অষ্টম শ্রেণীকক্ষটি পড়েছে স্কুল ভবনের দোতলায় । অভিভাবকগণের জন্যে এটি কোনভাবেই সমস্যা হতে পারে না! কিন্তু ওর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বাবা মাকে বিশেষভাবে ভাবায় সব কিছুতেই। আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতোই এটিতেও নেই কোন র্যাম্প অথবা লিফটের সুব্যবস্থা।
গতবছরের শুরুতে এরচে’ বেশি সমস্যায় পড়তে হয়েছিলো ওকে নিয়ে। কোন স্কুল কতৃপক্ষই ওকে ভর্তি করাতে রাজী হচ্ছিলেন না। কেউ কেউ পরামর্শ দিচ্ছিলেন ওকে বিশেষ স্কুলে ভর্তি করানোর জন্যে। নীলা শুধু মাত্র স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারে না। কিন্তু ওর চিন্তাশক্তি আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতোই সচল। পরীক্ষায় প্রথম হতে না পারলেও বরাবরই ভালো রেজাল্ট করেছে, সবসময়ে প্রথম ছ’-সাতজনের মধ্যে থেকেছে। এইটুকুন বয়সেই এত ভালো ইংলিশ রপ্ত করেছে আমি নিজেই মাঝে মাঝে অবাক হয়ে উঠি। জেনে বুঝে কেউ বিশেষ করে তিনি যদি হয়ে থাকেন একজন ’মানুষ গড়ার কারিগর’ এমন কথা কিভাবে উচ্চারিত হতে পারে তার কন্ঠে আমি আজ অব্দি বুঝে উঠতে পারলাম না!
বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দ্বারে দ্বারে ঘুরে অবশেষে ’চট্টগ্রাম রেসিডেন্সিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ’টির হালিশহরে অবস্থিত শাখার মহানুভব উপাধ্যক্ষ নীলাকে ভর্তি করাতে সম্মতি জানান। সপ্তম শ্রেণীকক্ষটি ছিলো দ্বোতলায়। নীলার জন্যে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠা কষ্টসাধ্য শুনে তিনি নিচতলায় বাথরুম সংলগ্ন একটি কেক্ষ নামিয়ে আনেন সপ্তম শ্রেণীকটি শুধুমাত্র নীলার সুবিধার্তে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেন শিক্ষক-শিক্ষীকাসহ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সকল কর্মচারিগন।
বছরশেষে আবারো আমার মায়ের চিন্তা- অষ্টম শ্রেণীকক্ষটি দ্বোতলায়, ”কতৃপক্ষ কি একজন ছাত্রীর জন্যে প্রতি বছর বিশেষ ছাড় দেবে!?” বার্ষিক পরীক্ষা শেষে উপাধ্যক্ষ মহোদয়ের কাছে মা জানতে চাইলে তিনি বলেন প্রতি বছর বাচ্চারা একি ক্লাসরুমে পড়তে চায় না। আতঙ্কে আমি ভীষণ অস্থির হয়ে পড়ি। কারণ মায়ের চিন্তা স্কুলকতৃপক্ষ যদি শ্রেণীকক্ষ নিচতলায় নামিয়ে না আনেন নীলাকে ঘরেই শিক্ষক রেখে পড়াবেন। আর স্কুলের চাপ থেকে দূরে সরে গিয়ে ঘরে পড়ালোখার ভবিষ্যৎ কি হতে পারে তা আমারচে’ ভালো কে জানে!
”মাসকুলার ডিসট্রফি” নামক অসুখটি যখন ছোট্ট নীলার শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ে তখন থেকেই আমি সবসময়ে একটা আতঙ্কের মাঝে থাকি। প্রতিমুহুর্তে মনে হতে থাকে এই বুঝি আমার জীবনের নিকষ কালো ছায়া ওর ওপরে এসে পড়লো....এই সব ছোটখাট সমস্যার কারণে আমার পড়ালেখাও সেই ছোট্টবেলায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। নীলাকেও যেনো একি পথের পথিক হতে না হয়। ওকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন আছে.... সবার মতোই পড়ালেখা শেষ করে নিজের পায়ের নিচে শক্তভিত্তি তৈরি করবে। আমি যা করতে পারিনি ও তা করে দেখাবে!
গত একমাস চরম দুশ্চিন্তায় কাটানোর পর অবশেষে উপাধ্যক্ষ মহদোয় রাজী হন শ্রেণীকক্ষ নিচতলায় নামিয়ে আনতে। অষ্টম শ্রেণীতে নীলাকে ভর্তি করানোর পর এখন একটু শান্তি। কিন্তু এভাবেও আর কতদিন! এই স্কুলে যতদিন আছে ততদিন হয়তো নিশ্চিন্ত। তারপর? অন্য কোথাও ওকে ভর্তি করানো যাবে তো!
যতদিন যাবে ওর শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হবে। এখনো ও নিজে হাঁটতে পারছে আর ক’দিন বাদে সেটাও সম্ভব হবে না, তখন? কোলে করে সবার সামনে দিয়ে ওকে আনা নেওয়ার সময়ে মানুষের তির্যক চাউনি এবং সেই সাথে কটু মন্তব্য যে কতটা ভয়াবহ যন্ত্রণাদায়ক! সাধারণ মানুষ যদি এর মর্ম কিছুটা বুঝতো! এই অবস্থার কি কোন পরিবর্তন নেই?
প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্প হলেও কিছু বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে প্রতিবন্ধি শিশুদের জন্যে আর তা হলো অন্ধ প্রতিবন্ধি শিশুদের জন্যে ব্রেইল পদ্ধতির বিশেষ ব্যবস্থা, বাক্ ও শ্রবণ প্রতিবন্ধি শিশুদের জন্যে ইশারাভাষা পদ্ধতি এবং বুদ্ধি প্রতিবন্ধি শিশুদের প্রতি বিশেষ যত্নবান হতে কিংবা তাদের বেড়ে উঠার স্বাভাবিক পরিবেশ গড়ে তোলার ল্েক্ষয রয়েছে বেশ কিছু বিশেষ বিদ্যা নিকেতন। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধি শিশুরা না পারে বিশেষ স্কুলে যেতে না পায় স্বাভাবিক স্কুলে যাওয়ার যথাযথ পরিবেশ। আমাদের দেশের মানুষের মাঝে একটা ধারনা বদ্ধমূল প্রতিবন্ধি শিশুরা বিশেষ স্কুল ছাড়া স্বাভাভিক স্কুলে অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে পড়তে পারবে না। এই ধারনাটি একেবারেই ভুল। শারীরিক প্রতিবন্ধি শিশুদের শুধুমাত্র সর্বোচ্চ প্রবেশের সুবিধেটুকু প্রয়োজন হয় আলাদা শিক্ষাব্যবস্থা নয়। লিফটের সুব্যবস্থা না থাকলেও শারীরিক প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থীদের যাতায়াত নিশ্চিত করতে স্বল্প খরচে র্যাম্প বা ঢালু পথ এবং বাথরুম সংলগ্ন একটি শ্রেণীকক্ষ যদি প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তৈরি করা যায় হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের জন্যে অতি সহজেই প্রবেশগম্যতা তৈরি হয়। আমার জানা মতে সরকারি কিছু সংখ্যাক স্কুল এবং ঢাকায় দু’একটি বেসরকারি স্কুলে ছাড়া কোথাও র্যাম্প নেই। আমাদের দেশে শুধুমাত্র স্বাভাবিক প্রবেশগম্যতা নেই বলে শারীরিক প্রতিবন্ধি শিশুরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বঞ্চিত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবন যাপনের আনন্দ থেকে।
তবুও একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তো এগিয়ে এলো আমাদের দুঃশ্চিন্তামুক্ত করতে!
আমাদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ’বি-স্কেন’এর পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ জানাই স্কুল কর্তৃপক্ষসহ প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত সকলকে। একবুক আশা নিয়ে প্রত্যাশা করি দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে নীলার মতো হাজারো শিশুর জন্যে শিক্ষার পরিবেশ উন্মুক্ত করবে।
লেখকঃ সাবরিনা সুলতানা, ২৮ ডিসেম্বর, ২০০৯।
sabrina@b-scan.org
2 মন্তব্য(সমূহ):
Carry on!
Will do,thanks.
Post a Comment