একজন জীবনযোদ্ধা


রুমা যে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানটিতে সিনিয়র রিসেপশেনিস্টের কাজ করছে তার পরিবেশটি বড়ই মনোরম। গাছগাছালি ঘেরা সবুজ এক চিত্রপট যেন। পাখিদের কল কাকলিতে মুখর স্নিগ্ধ পরিবেশ। 

হোস্টেল,ক্যান্টিন,বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র,ওয়ার্কশপ,নার্সারি ইত্যাদি নিয়ে বিশাল এক কম্পাউন্ড। খুব সুন্দর একটি পুকুরও রয়েছে যার শাঁনবাধানো ঘাটে বসে অনায়াসে জোঁছনা উপভোগ করা যায়। চারিদিকের দৃশ্য এমনিতেই মানুষের মন ভাল করে দেয়। কিন্তু রুমা এর কিছুই উপভোগ করতে পারে না,সে শুধু অফিস আর রুম,রুম আর অফিস এই চক্রে আবর্তিত।কারণ সে তার নিজের হুইলচেয়ারটি নিজে হাত দিয়ে চালাতে পারে না,চালাতে হয় পা দিয়ে,কিন্তু মসৃণ পথ না হলে তা সম্ভব হয় না। তাই একজন লোক আছে তার যে তাকে সকালে এসে অফিসে দিয়ে যায় আবার সন্ধ্যায় ছুটি হলে রুমে পৌঁছে দিয়ে যায়। ঐ প্রতিষ্ঠানেরই হোস্টেলে একাই থাকে সে। রুমে তার চলাফেরায় তেমন অসুবিধা হয় না। কারন সকল ব্যবস্থাই তার উপযোগী করে করা।

রুমা খুব স্বাধীনচেতা একজন নারী। চাকরি মানেই কারো অধীনে কাজ করা। যা তার মোটেই পছন্দ ছিল না। ইচ্ছে ছিল স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে ঘর সংসার করার পাশাপাশি একটি ছোটখাট ব্যবসা থাকবে তার। কিন্তু হায় বিধাতা! বোধহয় হেসেছিলেন সেদিন। আজ সে মানুষ এমনি অবস্থার স্বীকার যা তাকে প্রতি মূহুর্তে পরাধীনতার কথা মনে করিয়ে দেয়।


ছোটবেলায় তিন বছর বয়সে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিজ(Rheumatoid Arthritis)-এ আক্রান্ত হয় সে। আর্থ্রাইটিজের কারনে ওর পা বাঁকা হয়ে যেত তাই সবসময় ওকে ক্রেপ ব্যান্ডেজ পরে থাকতে হতো। তিন/চার বছর চিকিৎসার পর সম্পূর্ণ ভাল হয়ে উঠে সে এবং ক্লাস থ্রি তে ভর্তি হয়। দিনগুলো তার কেটে যাচ্ছিল মহাসুখে। তিন ভাইয়ের আদরের একমাত্র বোন সে। নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি ঘর দোর গুছিয়ে রাখা,ভাইদের সাথে ব্যাডমিন্টেন খেলা,গাছে চড়া,স্কিপিং করা কি না করতো সে। খোলা আকাশে ডানা মেলা পাখিদের উড়ে বেড়ানো দেখতে খুব ভাল লাগতো তার। ডিগ্রী পাসের পর চারিদিক থেকে তখন বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু হয়েছে, জোরে সোরে চলছে পাত্র দেখা । রুমার দুচোখ জুড়ে তখন একটি ছোট্ট সুখের সংসারের স্বপ্ন, একটি সন্তানের আকাংক্ষা। একজন অজানা মানুষের আগমনের অপেক্ষা, যার হাত ধরে শুরু হবে নতুন পথ চলা। কিন্তু গল্পটা সেভাবে এগোয় নি।


একদিন রাতে ও ডাত্তার দেখিয়ে রিকশায় করে বাড়ী ফিরছিল ওর বাবার সাথে, গায়ে ছিল জ্বর। ওরা যখন বাড়ীর কাছে ব্রিজের উপর এসেছে ঠিক তখনই হঠাৎ পিছন থেকে একটি ট্রাক ওদের রিকশাটিকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। রুমা রিকশা থেকে ছিটকে ব্রিজের নিচে পরে যায়। এক বেপরোয়া ট্রাক ড্রাইভারের খামখেয়ানিপনা চুরমার করে দিয়ে যায় আরও একটি মেয়ের ভবিষ্যৎ। রিকশাচালক আর ওর বাবা অনেক কষ্টে রুমাকে উপড়ে তুলে আনে,রাস্তায় তখন কোন লাইটও ছিল না। সেই সড়ক দূর্ঘটনার কমোড়ের হাড় ভেংগে যায় তার এবং সেটা রিপ্লেইস করতে হয় দূর্ঘটনার তিন বছর পর। সেটাও দূর্ঘটনার কারণে ওর যে ব্যথাটি হচ্ছিল, ডাক্তারদের সঠিক কারণটি সময়মত নির্ণয় করতে না পারার ফল। চলে যেতে হয় ইন্ডিয়া হিপ জয়েন্ট রিপ্লেইস করতে। অনেকদিন চলাফেরা বন্ধ থাকায় ফিরে আসে সেই পুরনো রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিজ। ওর রোগটায় চলাফেরার মাঝে থাকতে হয়, ব্যয়াম করতে হয় কিন্তু আর্টিফিসিয়াল হিপ জয়েন্ট ভেংগে যাবার আশংকায় ফিজিওথেরাপি করা আর সম্ভব হচ্ছে না। তাই ওর শরীরের জয়েন্টগুলো সব শক্ত হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, ১৯৯৬ থেকে ২০০৯ কম সময় নয়, অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে ওর শরীরের। রুমা এখন আর দাঁড়াতে পারে না। দুই হাঁটুর বাটিগুলো পরিবর্তন করতে হবে। শেষ হয়ে গেছে অন্য হিপ জয়েণ্টও, সেটাও পরিবর্তন করা দরকার। চলাফেরা বা বসা যতটুকু তা নাকি মেরুদন্ড দিয়েই চলছে, কিছুদিন আগের সর্বশেষ ডাক্তারের রিপোর্ট তাই বলছে।

ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস নতুন সংসারতো দূরের কথা আজ নিজের বাবা মার কাছে থাকারও কোন উপায় নেই তার। কারন রুমার বাবা তো আর ভাবেন নি যে তার মেয়েটির এই করুণ পরিণতি হবে, তাই বাড়িটি সেইভাবে তৈরী হয়নি, যার কারনে বাড়িতে থাকলে ওর চলাফেরা অনেক কমে যায়। বাথরুম বা পাকের ঘরের দরজাগুলো তৈরী হয়নি কোন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীর কথা মাথায় রেখে, নেই লিফট। দোতলা বাড়ীটির নিচতলায় ভাড়াটিয়ারা থাকতো, কিন্তু রুমার পক্ষে এখন আর দোতলায় উঠা সম্ভব হচ্ছে না বলে নিচতলাতেই তাদের উঠিয়ে দিয়ে, একটি রুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে ওর জন্য। বাড়ী গেলে রুমা সেখানেই থাকে। রুমার বাবা মা আজ একটি ভীষণ মনোকষ্টে ভোগেন, ভাবেন তখন যদি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে তাঁদের কেউ সচেতন করতেন তাহলে বাড়ী তৈরীর সময় অবশ্যই তিনি দরজাগুলোর দিকে বিশেষ নজর দিতেন, রাখতেন লিফটের ব্যবস্থাও। তাহলে হয়তো আজ তাঁদের আদরের একমাত্র মেয়েটিকে রাখতেন পারতেন নিজেদের কাছেই। তারপরও রুমা ভাগ্যবতী কারন পরিবারের সবাই তাকে ভীষণ ভালবাসে। তার সব সাফল্যের পিছনেই আছে তার পরিবারের সহযো্‌গী মনোভাব।


আমার দেখা একজন সংগ্রামী নারী,রুমা। নিজের শত প্রতিবন্ধিতা যার মুখের হাসি এতটুকু কেড়ে নিতে পারে নি। যে মেয়েটি সারারাত ব্যথায় ঘুমাতে পারে না সেই মেয়েটিই সকালবেলা রিসেপশেন ডেস্কে কি করে হাসি মুখে কাজ করে আমার ভাবতে ভীষণ অবাক লাগে।


রুমার কষ্টের আমি কোন কুল কিনারা পাই না। একবার ভাবুনতো মানুষ যদি তার হাতটিকে সম্পূর্ণ ভাঁজ করতে না পারে তাহলে খেতে,মাথার চুল আঁচড়তে,জামা কাপড় পড়তে কতটা অসুবিধার সম্মুখিন হবে? তার ঘাড়টি যদি ডানে বাঁয়ে ঘুরানো না যায় তাহলে? তার হাতের আংগুলগুলো যদি শক্ত হয়ে আসে তখন? হাঁটুর জয়েণ্ট যদি আর কাজ না করে কি করে দাঁড়াবে সে? যদি সে আর উপুড় হতে না পারে,তাহলে নিচু হয়ে কিছু করা বা তোলা কতটা কষ্টসাধ্য? এই সবগুলো কাজ করতেই রুমার খুব কষ্ট হয় বা পারে না। হুইলচেয়ারটিই এখন তার একমাত্র সঙ্গী। সেই সাথে আছে প্রচন্ড শারীরিক ব্যথা,তবে ওর সাথে কথা বলার সময় আপনি কিন্তু তা বিন্দু মাত্র বুঝতে পারবেন না।


রুমার গুনেরও কিন্তু শেষ নেই। সে ভাল ছবি আঁকতে পারে, ওর আঁকা ছবি নিয়ে বেশকিছু একজিবিশেনও হয়েছে, তৈরি হয়েছে কালেন্ডার, ভিউকার্ড। সেই রয়াল্টির টাকা রুমা দান করেছে প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে। বিভিন্ন একজিবিশেনে গিয়ে বড় বড় শিল্পীদের ছবি দেখে অনুপ্রেরণা পাবার পথটিও আজ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে ওর জন্য কারণ বাংলাদেশে শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য সহায়ক যাতায়াত ব্যবস্থা  এখনো গড়ে উঠে নি। ঢাকার অদূরে থাকায় ট্যাক্সিক্যাব এ করে যাওয়াটা বেশ ব্যয়হুল হয়ে যায় তাই সবসময় তা সম্ভব হয়ে উঠে না। তারপরও সে মাঝে মাঝে যায় বেঙ্গল গ্যালারীতে।


ভিডিওগ্রাফির উপর ট্রেইনিং আছে ওর। অনেক ভিডিও চিত্রও তৈরী করেছে সে প্রতিবন্ধীদের সচেতনতার উপর, তার প্রতিষ্ঠানের জন্য, যেগুলো একসময় টিভিতে প্রচারিত হয়েছে। সুচিকর্মেও সুনিপুনা সে। ওর লেখালেখির হাতও খুব ভাল। বাংলাদেশের প্রতিবন্ধীদের ব্যপারে মানুষকে সচেতন করার জন্য অনেক লেখাই ছাপা হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। সে প্রায়ই লেখে প্রতিবন্ধীদের প্রতিবন্ধকতার কথা, বিশেষ করে যারা শারীরিক প্রতিবন্ধী,পদে পদে তারা কত বাঁধার সম্মুখিন ঘরে ও বাইরে। আজকাল লিখতে কষ্ট হয় বলে ওর লেখা কমে গেছে অনেক। রুমা প্রবন্ধ ছড়া,গল্পও লেখে।


শত প্রতিবন্ধকতা সত্তেও রুমা খুব চমৎকার রান্না করতে পারে,মজার মজার রান্না করা ওর সখগুলোর অন্যতম। সারাদিনের ক্লান্তির পর অনেকেই যেটাকে ঝামেলা মনে করে সেটাই যেন ওর পরম আনন্দের জায়গা। ও সবসময় দুঃখ করে বলে আমার এতো ভাল লাগে রান্না করতে, অথচ দেখো খাওয়ানোর মানুষ নেই। অথচ একটা সময় ছিল যখন ও এটা ওটা রান্না করে খাওয়াতো বাড়ীর সবাইকে। এখন যে সে একা থাকে, কাছে নেই বাবা মা ভাইদের কেউ, তাই ভাল কিছু রান্না করলেই ওর মনটা অনেক খারাপ হয়ে যায়। বিশেষ করে ঈদের দিনগুলোয় ও যেন কিছুতেই স্বাভাবিক থাকতে পারে না। মনে পরে যায় পুরানো দিনের কথা। যখন মায়ের সাথে তৈরী করতো নানা রকম খাবার, আজ ঈদে বাড়ী গিয়ে শুধু দর্শক হয়ে বসেই থাকতে হয়, কিছুই করা হয় না। তাই ঈদ রুমার জন্য কোন আনন্দের দিন নয়, এ যেন এক শোক দিবস। কিছুতেই যেন দু’চোখের পানি আর বাঁধ মানে না।

- সালমা মাহবুব
৩ অক্টোবর, ২০০৯, জনকন্ঠ।

0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment

 
Design by Oronno Anam | Bloggerized by Salma Mahbub