পাহাড় জয়ের গল্প

পাহাড়-পর্বতে ওঠা চাট্টিখানি কথা নয়। এর জন্য প্রয়োজন কঠোর অনুশীলন আর শারীরিক সক্ষমতা। পাহাড়ের পদে পদে জড়ানো রয়েছে বিপদ আর মৃত্যুর হাতছানি। মৃত্যু এখানে খুব সহজ ও স্বাভাবিক একটি বিষয়। তার পরও জেদি আর একরোখা মানুষ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে না। নেশা কিংবা শখের বশে জয় করতে চায় পাহাড়। হোক না মৃত্যু। পাহাড়ে উঠতে গিয়ে বীরের মতো মরণকে বেছে নেওয়াই যেন ভালো। পাহাড় জয় করার জন্য এ ত্যাগটুকু স্বীকার করতে ওদের বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। এমন সব ভাবনা আর নেশার বশে ফি-বছর কিছু লোক যাত্রা করে কিলিমানজারোর দিকে। আফ্রিকার সবচেয়ে উঁচু পর্বত। পাহাড়ে চড়া মানুষের কাছে এ পর্বতটি অতি প্রিয়। শারীরিকভাবে সক্ষম এবং পাহাড়ে চড়ার কসরত সম্পর্কে জানা ঝানু লোকজনের কাছে বড্ড রোমাঞ্চকর এ যাত্রা। ১৭ হাজার ৩৪০ ফুট দূরত্ব অতিক্রম করতে গিয়ে প্রায়ই হার মেনে বসে আরোহীরা। তাই সাহসী আর সবল মানুষই শুধু দলে দলে যাত্রা করে এ পাহাড়টির দিকে। এই মানুষজনের ভিড়েই যদি কোনো এক পর্বতারোহী মাত্র একটি পায়ে ভর করে পাহাড়ের কঠিন বুকে পা ফেলে ফেলে উঠে যায় ওপর থেকে ওপরে, তখন অবাক হতে হয়। এক পা নিয়ে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরাটাই যেখানে কষ্টকর, সেখানে পাহাড়ে ওঠাটা দুঃসাহসের শামিল। আর এমন দুঃসাহসিক কাজটিই করেছেন সারাহ ডোহার্টি। তিনি কিলিমানজারোর উদ্দেশে যাত্রা করে হয়েছেন সফল। একটি মাত্র পা নিয়ে জয় করেছেন কিলিমানজারো। আজকের গল্পটা সারাহ ডোহার্টিকে নিয়ে। পাহাড়ে ওঠার পেছনে তাঁর কষ্টসাধ্য পরিশ্রম আর সংগ্রামের কথাগুলোই শুনব আমরা আজ।

মুক্তির স্বাদ
সারাহকে পাড়ার সবাই দস্যি মেয়ে হিসেবেই জানে। দিনমান দৌড়ঝাঁপ করেই কাটে তাঁর সময়। সাঁতার কিংবা সাইকেল চালানো, সবকিছুতেই বন্ধুদের চেয়ে সেরা সারাহ ডোহার্টি। এসব দস্যিপনা করতে করতেই একদিন ঘটে যায় একটি দুর্ঘটনা। সড়ক দুর্ঘটনায় হারাতে হয় নিজের ডান পা। এর পরের দিনগুলো ছিল বড় যন্ত্রণার। চলাফেরার স্বাধীনতা যেন হারিয়ে যাচ্ছিল দিনকে দিন। তবে সারাহ ভেঙে পড়ার মতো মেয়ে নন। তাই পা হারানোর পর বলছিলেন, ‘আমি জানি, কিছু স্বাধীনতা আমি হারিয়েছি, তাই বলে সাধারণ সুস্থ মানুষের মতো জীবন যাপন করা থেকে বঞ্চিত হতে চাই না কখনো।’ নিজের ক্রাচ নিয়ে ২০০৪ সালের দিকে ৭২০ কিলোমিটার ট্রেকিং করেন সারাহ। এর পরই বেড়ে যায় অত্মবিশ্বাস। শৈশব থেকেই ছিল পাহাড়ে চড়ার নেশা। তাই মনস্থির করলেন, কিলিমানজারোর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করবেন। রেইনার ও আলাস্কা পর্বতে ওঠার অভিজ্ঞতা জমা আছে তাঁর ঝুলিতে; বুকের ভেতর নেই সাহসের কোনো কমতি। ধীরে ধীরে সম্পন্ন করা হলো পাহাড়ে ওঠার প্রস্তুতি। নিজের তিন ছেলেমেয়ের অনুমতি নিয়ে শুরু হলো যাত্রা। সারাহর সঙ্গী হিসেবে রওনা হলেন তাঁরই যমজ বোন সুসান গ্যাব্রিয়েল। একটি পা নিয়ে এমন দুঃসাহস দেখানোর কারণে দুয়োধ্বনি তুলছিল নিন্দুকেরা। সারাহ এসবে কান দেননি। এতে শুধু সময়ের অপচয় হয়। প্রথমে তাঁরা পৌঁছালেন কিলিমানজারোর কাছাকাছি তানজানিয়ান গ্রাম মারাঙ্গুতে। পথে ঝামেলা হয়নি কোনো। শুধু পরিশ্রমের ফলে মাঝেমধ্যে মাথায় ব্যথা হতো সারাহ ডোহার্টির। যন্ত্রণা ভুলতে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটছিল ঘুমিয়ে। গ্রামটিতে কিছুদিন জিরিয়ে নেওয়ার পর রওনা হন কিলিমানজারোর দিকে। সামনে আর থামার ইচ্ছা নেই তাঁর। কঠিন এক গোঁ ধরেছেন সারাহ। যেভাবেই হোক, জয় করতে হবে কিলিমানজারো। তাই শুরু হয়ে গেল রোমাঞ্চকর এক যাত্রা।

কিলিমানজারো
১৬ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতায় ওঠার পর সবার মনে জেঁকে বসে হাইপোথারমিয়ার ভয়। কিন্তু থেমে থাকতে রাজি নন সারাহ। একবার থেমে গেলে হয়তো উবে যাবে ভেতরের সব উদ্দীপনা, উৎসাহ। বিশেষভাবে তৈরি অ্যালুমিনিয়ামের ক্রাচ নিয়ে পোহাতে হয়েছে অনেক ঝামেলা। কিলিমানজারোর আবহাওয়ায় নিজেকে মানিয়ে নিতেও কষ্ট হচ্ছিল খুব। চূড়ার একদম কাছাকাছি গিয়ে ঘটল আরেক দুর্ঘটনা। বাঁ পায়ের ক্রাচটি গেল ভেঙে। ভরসা করতে হলো গাইডের ওপর। তার কাঁধে ভর দিয়ে দিয়ে এগোতে হলো অনেক কষ্টে। পথিমধ্যে ক্যাম্প থেকে মেরামত করা হলো ক্রাচটি। গিলসম্যান পয়েন্টে ওঠার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন সারাহ। লক্ষ্যে পৌঁছাতে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না তাঁকে। অতিক্রম করতে হবে সামান্য কিছু দূরত্ব। সর্বোচ্চ উচ্চতায় যেতে হলে পৌঁছাতে হবে ১৯ হাজার ৩৪০ ফুট উচ্চতায়। কিছু সময় পর ক্রাচে ভর দিয়ে যখন সেখানে পৌঁছালেন সারাহ, তখন আনন্দে চিৎকার শুরু করলেন গাইড আর সঙ্গী যমজ বোন। বিজয়ের আনন্দে জল ভিড় করল সারাহর চোখে। স্বপ্নটা সত্যি হলো অবশেষে। বড্ড ক্লান্ত এখন তিনি। প্রয়োজন বিশ্রাম। প্রয়োজন একটুু আরামের ঘুম শেষে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা কফি। ‘ও আসলেই একটা অসাধারণ কাজ করেছে। পুরো অভিযানে বোনের পাশে থেকে ধন্য আমি। ডোহার্টির এই সাহস দেখে সত্যিই অবাক হয়েছি।’ হাসতে হাসতে বলছিলেন যমজ বোন সুসান। পাহাড় থেকে ফিরে এসে দিনগুলো কাটছে আনন্দে। চারপাশে শুধু সারাহকে ঘিরে উৎসব। এমন সফলতায় আনন্দিত সবাই।
বয়স ৫০ হতে চলল সারাহ ডোহার্টির। নিজের সন্তানেরাও বেড়ে উঠছে ধাই ধাই করে। চেহারায় তবু বার্ধক্যের ছাপ নেই সাহসী সারাহর। তাঁর মতে, সবে তো শুরু হলো জীবনটা। সামনে যেতে হবে আরও নতুন নতুন অভিযানে। জয় করতে হবে অজানা পৃথিবীটা।


ওয়েবসাইট অবলম্বনে


কিঙ্কর আহ্সান 

সুত্রঃ ছুটির দিনে, প্রথম আলো, ২৫/৯/২০১০।

 ইচ্ছাশক্তিই পারে

‘যদি লক্ষ্য থাকে অটুট আর বিশ্বাস হূদয়ে, হবেই হবে দেখা, দেখা হবে বিজয়ে।’ হ্যাঁ, দেখা হবে সাফল্যের সঙ্গেও। লক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গে আত্মবিশ্বাসের পারদকেও সব সময় রাখতে হবে অনেক ওপরে, যেন কোনো অবস্থাতেই ব্যর্থতা এসে গ্রাস করতে না পারে। তবেই হবে লক্ষ্যে পৌঁছানো, পাওয়া যাবে সফলতার স্বাদ। তবে সবাই তা করতে পারেন না। আর যাঁরা পারেন, তাঁরা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকেন। তেমনি একজন আমেরিকার মার্ক ওয়েলম্যান। তিনি একাধারে পর্বতারোহী, অ্যাথলেটিক এবং ধারাবর্ণনাকারী। বাদামি গোঁফওয়ালা ওয়েলম্যানের বয়স যখন ১২ তখন থেকেই তাঁকে পর্বতারোহণের নেশা পেয়ে বসে। ধরতে গেলে পর্বত আরোহণটাই তাঁর পৃথিবী হয়ে ওঠে। সুযোগ পেলেই আজকে এখানের, তো কালকে ওখানের পাহাড়ে ওঠার দুর্নিবার চেষ্টা। তাঁর বয়স যখন ২১ তখন একটা পাহাড় থেকে নামতে গিয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন। এতে তাঁর কোমরের নিচ থেকে পা পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে অকেজো হয়ে যায়। সাড়ে সাত বছর চিকিৎসাধীন থাকার পর তিনি মনস্থির করলেন, আবার পাহাড়ে উঠবেন, সেটা যেভাবেই হোক। তার পরেরটুকু ইতিহাস। তিনি বিকলাঙ্গ হয়ে গেলেও ভেঙে পড়েননি। নিজেকে অসহায়ত্বের কাছে সমর্পণ করেননি, তাঁর কক্ষপথেই অবিচল ছিলেন। তিনি একটি বিশেষ ধরনের হুইলচেয়ার কিনলেন, যেটার মাধমে শরীরের নিচের অংশ চেয়ারের সঙ্গে আটকে থাকে। এরপর তিনি এবং তাঁর আরেক পর্বতারোহী বন্ধু মাইক কর্বেট মিলে ক্যালিফোর্নিয়ার ইয়োসেমিতে ন্যাশনাল পার্কের ৩০০০ ফুট উচ্চতার পৃথিবীর সর্বোচ্চ উচ্চতার শিলাখণ্ডের পর্বত ইআই কাপিতান আরোহণ করেন ১৯৮৯ সালে। ১৯৯১ সালে তাঁরা দুজনে মিলে আবার ইআই কাপিতানের পাশের আরেকটু উচ্চতার পর্বত হাফ ডোম বিজয় করেন। এভাবে তিনি প্রায় ৫০টির মতো পর্বতারোহণ করেন। মার্ক ওয়েলম্যান স্কি খেলাতেও দক্ষ। তিনি আমেরিকার স্কির জাতীয় দলের খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি জাতীয় দলের হয়ে দুটি প্যারা অলিম্পিকেও অংশ নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর লিখিত বই ক্লাম্বিং ব্যাক-এ তাঁর জীবনের প্রতিটি উত্থান-পতনের কথা বিস্তৃত করেছেন। কীভাবে তিনি উৎসাহ পেয়েছেন, শেষ পর্যন্ত তিনি কীভাবে সফল হয়েছেন, তা তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি ভালো একজন বক্তা হিসেবেও সুপরিচিত। ওয়াশিংটনভিত্তিক ডিজএবল স্পোর্টস, ইউএসএর ধারাবর্ণনাকারী ও ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্য সরকারের খেলাধুলাবিষয়ক উপদেষ্টা তিনি। বর্তমানে তিনি নো লিমিটস নামে একটি সংগঠন খুলেছেন উত্তর ক্যালিফোর্নিয়াতে, যেখানে তিনি পর্বতারোহণ সম্পর্কে কোচিং করান। মূলত যাঁরা শারীরিকভাবে অক্ষম, তাঁদের নিয়েই তিনি কাজ করেন। মাঝেমধ্যে তিনি ক্যাম্পেইন করেন, যাতে সমাজের অবহেলিত মানুষগুলো আশা না হারায়, উৎসাহ পায়।
সুত্রঃ প্রথম আলো, ২৯/৯/২০১০।
http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-09-29/news/97147

এক টুকরো রোদ্দুর


শারিরীক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কিছু কাজ করতে গেলে যে কথা আমার মনে সবার আগে আসে, সেটা হল “প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু করা মানে আসলে ভগবানের সেবা করা। আমার কাছে হুইলচেয়ার মানে নারায়নের রথ, ক্রাচ মানে মহাদেবের ত্রিশূল”। বলছিলেন সৈয়দ সালাউদ্দিন পাশা, পৃথিবীজোড়া যার হাজার হাজার শিষ্যের কাছে পরিচিতি ‘গুরুজী’ নামেই, অনুষ্ঠানের আগে। পাশাজী এসেছিলেন ব্যাঙ্গালোরে, এক অনুষ্ঠানে, কিছুদিন আগে

সীমাহীন সক্ষমতা (Ability Unlimited)
এবিলিটি আনলিমিটেড নামক সংস্থাটির জন্মের শুরু থেকে নিজের সন্তানের মত করে লালনপালন করে চলেছেন গুরুজী। ভারতনাট্টম ও কত্থকে প্রশিক্ষিত হবার পর আর পাঁচজনের মত নাচের শিক্ষক না হয়ে গুরুজী ঠিক করলেন নাচ শেখাবেন তাদের, যাদের নিয়ে আমাদের সমাজ নাচ তো দূরের কথা, তারা যে আদৌ কোন অনুষ্ঠানের যোগ্য সে কথা ভাবতে পারে না। হ্যাঁ, তিনি ঠিক করলেন, নাচ শেখাবেন শারিরীক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে। 

কিন্তু এত কিছু থাকতে নাচ কেন?

নৃত্যকলা হল, আবেগ,অনুভূতি, শারিরীক ও মানসিক ভাব বিকশিত করার জন্য শ্রেষ্ঠ শিল্পমাধ্যম। জন্ম হল ১৯৮৮ সালে, যদিও রেজিস্ট্রী হতে হতে পেড়িয়ে গেছিল অনেকগুলো বছর, শেষমেষ ২০০৯ সালে সরকারী শিলমোহর লাগল। ততদিনে সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এর নাম। মূল লক্ষ থেকে কিন্তু একটুও বিচ্যুতি ঘটেনি- শারিরীক প্রতিবন্ধীদের মানসিক এবং শারিরীক বিকাশের সাথে সাথে শিক্ষা, সংস্কৃতি, কলার বিকাশ ঘটানো। একই সাথে, প্রতিবন্ধীদের সমানাধিকার, এবং সমান সু্যোগের জন্য চেষ্টা করে যাওয়া। যাতে তারা আর পাঁচজনের মত সমাজে মাথা উঁচু করে, সম্মানের সাথে, বাঁচতে পারে। এ পর্যন্ত মঞ্চস্থ বহু সফল অনুষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, রামায়ন অন হুইল, ভরতনাট্যম অন হুইল, ভগবত গীতা, সুফী অন হুইল ইত্যাদি।


কিভাবে চলে প্রশিক্ষন? 

প্রত্যেক শারিরীক প্রতিবন্ধীর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে- যখন তাদেরকে প্রথম  প্রশিক্ষন দিতে নিয়ে আসা হয়, দেখা হয় কি ধরনের সক্ষমতা রয়েছে তাদের। সেই অনুযায়ী তাদের চরিত্র নির্বাচন করা হয়ে থাকে। পাশাজীর ভাষায় ‘আমি যখন কাউকে প্রশিক্ষন দিতে শুরু করি, কোন প্রতিবন্ধীকে প্রতিবন্ধী হিসাবে না দেখে চেষ্টা করি তাকে একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে দেখার। এতে আমার কাজটাও অনেক সহজ হয়ে যায়; যে মূহূর্ত থেকে আমি তাদেরকে প্রতিবন্ধী হিসাবে দেখবো, তখন থেকেই বাঁধার সম্মুখীন হয়ে যাব, তাদের ভেতরের প্রতিভা বেড় করে আনাটাও কঠিন হয়ে যাবে’।

সহায়ক যন্ত্রসমূহ, যেমন ক্রাচ, হুইলচেয়ার- যে যেমন ব্যাবহার করেন চেষ্টা করা হয় মঞ্চে যেন সেটি যথোপোযুক্তভাবে ব্যাবহার করা হয়। প্রতিবন্ধীদের শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গপ্রতঙ্গকেই যেমন নাচে ব্যাবহার করা হয়, তার সহায়ক যন্ত্রটিও বাদ যায়না। তাই ক্রাচ হয়ে ওঠে তীর, ধনুক, অস্ত্র, রাজদন্ড। হুইলচেয়ার হয়ে ওঠে রাবনের পোশাক, সুফী নৃত্যের ঘাঘরা, কৃষ্ণের রথ। শেখান হয় কিভাবে নিয়ন্ত্রন করতে হবে হুইলচেয়ারকে।

প্রথম প্রথম পোষাক নির্বাচন নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছিল গুরুজীকে। হুইলচেয়ান বনবন করে ঘোরার সময় যাতে তা কোন সমস্যা না করতে পারে। তেমনই কঠিন শিল্পীদের কাছে এটা মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া, হুইলচেয়ারকে যাতে তারা নিজের পায়ের বিকল্প হিসাবে ভেবে নিতে পারে (এমনিতে হয়তো এটা আমরা সবসময়ই ভাবি, কিন্তু নাচের মুহূর্তে আরো বেশি করে দরকার)। সাধারণত হুইলচেয়ার ব্যাবহার করা হয় প্রতিবন্ধীদের চলাফেরার জন্য। ‘আমাদের প্রোডাকশন ডিপার্টমেন্টের অন্যতম প্রধান কাজ বিশেষ হুইলচেয়ার বানানো। আমি নিজে দীর্ঘদিন হুইলচেয়ার তৈরী করার কারখানায় দাঁড়িয়ে থেকে হুইলচেয়ার তৈরী করায় পরামর্শ দিয়েছি, এমনকি প্রতিবন্ধী শিশুদেরও নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছি। নাচের জন্য সম্পূর্ণ নতুন একধরনের হুইলচেয়ার তৈরী করা হয়েছে আমাদের উদ্যোগে’- জানালেন গুরুজ়ী।

পুরো প্রশিক্ষনটাই একটা শারিরীক ও মানসিক পদ্ধতি। ধৈর্‍্য্য, অধ্যাবসায়, নিষ্ঠা, আর কাজের প্রতি ভালবাসা হল সাফল্যের চাবিকাঠি। 

সেদিন অনুষ্ঠিত হওয়া নাচের মধ্যে ছিল রামায়ন ওন হুইল। আমি কথা বলছিলাম বিভিন্ন চরিত্রের অভিনেতার সাথে।

রামঃ নরেশ। ছোটবেলায় সেরিব্রাল পালসী হয়েছিল। কিন্তু রাম তো হিন্দু পুরানে ভগবান। গত দু বছরে তার আনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন সে হাঁটতে পারে, আগের থেকে অনেক স্পষ্টভাবে কথাও বলতে পারে। 

সীতাঃ শারিরীক প্রতিবন্ধী মেয়েটি নাচ-অভিনয় তো দূরে থাক, হাঁটতেও পাড়তো না। আজ ক্রাচ নিয়ে সে কলেজ থেকে ফেরার পথে রিহার্সাল দিতে আসে।

সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ালেও আজও কিন্তু প্রশিক্ষন খোলা গুরুজ়ির। খালি একটাই যোগ্যতা- হতে হবে শারিরীক প্রতিবন্ধী। বিশদ জানার জন্য দেখুন। 


লেখকঃ সায়ন ঘোষ (ভারত), ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১০।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী মোঃ মাহবুবুল আশরাফ আর নেই

জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফোরাম (এনএফওডব্লিউডি) এর সহ-সভাপতি, এশোশিয়েশন ফর দ্য ওয়েল ফেয়ার অব দি ডিজএ্যাবল্ড পিপল (এডব্লিউডিপি) এর সেক্রেটারী,বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি (বিপিকেএস) এর সাবেক সহকারী পরিচালক বিশিষ্ট প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক উন্নয়নকর্মী, গবেষক এবং অনুবাদক জনাব মোঃ মাহবুবুল আশরাফ গত ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৫:৫০ টায় মৃত্যুবরণ করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নালিল্লাহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৪৫ বছর।

তিনি দীর্ঘ কয়েকমাস যাবৎ লিভার সিরোসিস এবং ডায়াবেটিস রোগে ভুগছিলেন। কর্মজীবনে তিনি ভলান্টারি হেলথ সার্ভিসেস সোসাইটি (ভিএইচএসএস), বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি (বিপিকেএস), জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফোরামসহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিভিন্ন সংগঠন এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে ৩টি গ্রন্থ অনুবাদ করেন। তাঁর মধ্যে ইউএন এসকাপ কর্তৃক গৃহীত এশীয় এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দশক, ২০০৩-২০১২ ‘বিওয়াকো মিলেনিয়াম ফ্রেমওয়ার্ক ফর একশন-এর প্রাথমিক অনুবাদ অন্যতম। এছাড়াও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের তথ্য ভিত্তিক মাসিক সাময়িকী ‘স্পন্দন’ তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো। তিনি বহু গুণগ্রাহী, আত্মীয় স্বজন
রেখে গেছেন।

তিনি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুখ দুঃখের পাশে দাঁড়াতেন। তিনি একাধারে পরোপকারী, সৎ এবং নিষ্ঠাবান ব্যক্তি ছিলেন। দেশের সকল ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের একত্রিত করার জন্য প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন মোঃ মাহবুবুল আশরাফ ভাই। পারিবারিক এবং বন্ধুদের মাধ্যমে জানা যায়, তিনি পিঠের টিউমার অপারেশন করতে গিয়ে ডাক্তারের ভুল অপারেশনে স্পাইনাল কর্ডের সমস্যা হয়। ফলে আজীবনের জন্য চলার গতি হারিয়ে ফেলে। নিত্য দিনের সঙ্গি হিসেবে হুইলচেয়ারকে নিতে হয় তাঁকে। তিন চার মাস আগে হঠাৎ জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হন। গতকাল চিকিৎসাধানী অবস্থায় পিজি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ওনাকে একনজর দেখার জন্য বন্ধু-বান্ধব, সকল ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং আত্মীয় স্বজণরা হাসপাতালে ভিড় জমায়। সকলের আহাজারীতে আকাশ বাতাশ ভারী হয়ে ওঠে। জাতি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতাকে অকালে হারাল। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আল্লাহ ওনাকে বেহেস্তবাসী করুন।


সূত্রঃ ৬ সেপ্টেম্বর, আজমাল হোসেন মামুন,  সোনার বাংলাদেশের ব্লগ
http://www.sonarbangladesh.com/blog/blind10/5585

 
Design by Oronno Anam | Bloggerized by Salma Mahbub