মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির খোলা চিঠি

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

আমার সালাম ও শুভেচ্ছা নেবেন। বিভিন্ন সময়ে পত্রিকার মাধ্যমে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি আপনার একটা সহানুভূতির কথা জেনেছি। এছাড়াও শুনেছি আপনাদের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য অনেক কিছুই করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। সেখানে প্রতিবন্ধী মানুষের শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সহায়ক যাতায়াত ব্যবস্থা, যোগাযোগ সহজ করা এবং তাদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ব্যবস্তা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। তাই সাহস করে আজ কলম ধরেছি নিজের তিক্ত কিছু অভিজ্ঞতা আপনাকে জানাবো বলে।

যেদিন দুচোখ মেলে প্রথম ধরনীর আলো দেখি পরমমমতায় বাবা আমায় কোলে নিয়ে নামকরন করেছিলেন সাবরিনা। কবছর পরেই দূরারোগ্য মাস্কুলার ডিস্ট্রফী নামের এক ভয়ংকর রোগে আক্রান্ত হয়ে আমার শরীরের সমস্ত মাংসপেশী ধীরে ধীরে শক্তিহীন হয়ে পরে। আমি বন্দি হয়ে পড়লাম হুইলচেয়ারের চাকায়। সমাজে আবার নতুন নামকরন হলো আমার, প্রতিবন্ধী! বোধকরি এই নাম ও সমাজের কটাক্ষ চাউনি বাবা মার পছন্দ হলো না। শুরু হলো তাদের প্রণাান্ত চেষ্টা সমাজের চোখ থেকে আমাকে আঁড়াল করার। বন্ধ হয়ে যেতে লাগলো একে একে সবার দুয়ার। আত্মিয়-স্বজনের বিয়ে, আচার অনুষ্ঠান....বন্ধ হয়ে গেলো স্কুলের দুয়ারও! দূর দূরান্তে ঘুরে বেড়ানো....টোঁ টোঁ করে পাড়া বেড়ানো....সেই প্রাণবন্ত উচ্ছলতা কোথায় যেন হারিয়ে গেলো! আমি বন্দি হয়ে পড়লাম চার দেয়ালের কাল কুঠুরিতে !

আমার বেড়ে ওঠার পরিবেশটা ছিলো এমন-আমার সামনেই ছোট ভাইগুলো স্কুল কলেজে যাবে। বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাবে কিংবা পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোতে বাবা-মার সাথে স্বাভাবিকভাবেই উপস্থিত থাকবে আর আমাকে থাকতে হবে ঘরবন্দী হয়ে। আচমকা যদি বা কখনো বের হতাম রাস্তার মানুষজন হাঁ করে তাকিয়ে থাকতো এবং চারপাশ থেকে ছিটকে আসা বিরুপ মন্তব্যে বাবা মা বিব্রতবোধ করতেন। মানুষের নানা মুখী  প্রশ্নের তোড়ে আমার ঘর থেকে বাইরে বেরুনোর আনন্দে ভাটা পড়তো। ভাবতাম আমার মতো যারা সবাইকেই বুঝি একই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। এবং আমাদের জন্য এটাই স্বাভাবিক। দিনের পর দিন এভাবেই চলতে থাকবে....বেশ কবছর পর আমার ছোটবোনেরও একই রোগ ধরা পড়লো। পড়ালেখা চালিয়ে নিতে গিয়ে স্কুলে আসা যাওয়ার পথে বিরূপ মন্তব্য, সবার  তাকিয়ে থাকাকে কেন্দ্র করে সংকোচবোধ করে সে। মানুষের বিভিন্ন বাজে মন্তব্য তাকে কাঁদায়। ভাবায়। চোখের সামনে দেখতে পেলাম তার  জীবনে চলার পথের সবগুলো দরজাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একে একে।  আমার অসহনীয় যন্ত্রণাময় জীবনের প্রতিচ্ছবি তার চেহারায় ভেসে উঠতে দেখে মনটা বিদ্রোহী হয়ে উঠতে লাগলো।  বাইরের দেশগুলোর পরিবেশ তো অন্যরকম! সুস্থ্য সুন্দরভাবে বাঁচার জন্যে কিংবা প্রতিবন্ধী মানুষের ভবিষ্যৎ মজবুত করার লক্ষ্যে, তাদের পরিবার এবং সেখানকার মানুষেরা অনেক বেশি সচেতন। সিঙ্গাপুর মাস্কুলার ডিস্ট্রফী এসোসিয়েশেন এর ম্যানেজার পদে কর্মরত সেরিনা রো, ছোটবেলা থেকেই একি রোগে আক্রান্ত। অথচ ইলেকট্রিক হুইলচেয়ারে বসে সংসার ও কর্মস্থল স্বাভাবিকভাবেই চালিয়ে নিচ্ছেন তিনি। তিরিশ বৎসর বয়সী কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হ্যারি কখনো সুস্থ্য হয়ে উঠবে না জেনেও মা-বাবা ধৈর্যহারা না হয়ে প্রতি পদে নানাভাবে তাকে উৎসাহ যুগিয়েছে। তবে আমাদের দেশেই কেন প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি এহেন বৈষম্যমূলক আচরণ? জীবনের শুরুতেই তাদের জন্যে সব কিছুতেই কেনো হয়ে যায়  না!? স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, খেলার মাঠ, বিনোদন কেন্দ্র, আত্নীয়-স্বজনের বিয়ে, আচার অনুষ্ঠান, সব কিছুতেই তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। ধীরে ধীরে এই সমাজের হয়েও যেনো অবিচ্ছিন্ন একটি অংশ হয়ে পড়ে তারা। কেন???

আমার বর্তমান শারীরিক অবস্থা প্রচন্ড খারাপ, তবুও আপনাকে জানাবার ভীষণরকম তাগিদ থেকেই শরীরের ওপর জোর খাটিয়ে লিখতে বসেছি। আপনি জনগণের ভালোমন্দ দেখার কঠিন দায়িত্ব নিয়েছেন। আপনি আমার মায়ের মতোই।  তাই আপনার কাছেই আমার প্রশ্ন, আমি যদি আপনার মেয়ে হতাম সমাজের চোখ থেকে আমাকে এভাবে আড়াল করে রাখতে পারতেন? আপনিই বলুন, আমার সুস্থ ভাইয়েরা যদি পড়ালেখা করে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখতে পারে আমাদের কি অপরাধ?

বাংলাদেশের সংবিধানে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যাদের সারা বিশ্বে বলা হয় "অন্য রকমভাবে সক্ষম" তাঁদের বিশাল একটা জনগোষ্ঠি সমস্ত প্রকারের নাগরিক সুবিধে বঞ্চিত এ বিষয়ে ক'জনই বা মাথা ঘামায়। ২০১৫ সালের মধ্যে সবার জন্যে শিক্ষার কথা বলা হলেও সেই ১৯৮৫তে করা বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার পরিসংখ্যান মতে এক দশমাংশ নাগরিক বিভিন্ন ধরণের প্রতিবন্ধীতার স্বীকার। আর এ সংখ্যা গড়ে আড়াই লক্ষ্য করে প্রতি বছর বাড়ছে। ষোল লক্ষ প্রতিবন্ধী শিশুর মধ্যে মাত্র চার শতাংশ মূলধারায় শিক্ষার সুযোগপ্রাপ্ত। আজ পর্যন্ত আমাদের নিজেদের করা একটি সঠিক পরিসংখ্যানও নেই।

 আপনার সরকারের সময়েই প্রথমবারের মতোন আদমশুমারীতে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা নিরূপনের একটি উদ্যেগ নেওয়ায় সমাজ সংস্কারমূলক বাস্তবায়নের আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এবং সামাজিক ও নাগরিক এই বৈষম্য দূরীকরণে শুধু মাত্র প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্যে আলাদাভাবে একটি আদমশুমারী কার্যক্রম পরিচালনা করা অত্যান্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যাগত, প্রকারগত এবং পূর্ণাঙ্গ বিবরণ জানা গেলে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার প্রতিবন্ধীতার ধরণ অনুযায়ী তাদের জন্যে রাষ্ট্রের কি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত সেটা নিরুপন সহজভাবেই সম্ভব হবে। দেশের মূল জনশক্তিতেও তারা অবদান রাখার সুযোগ পাবে।

টিভিতে এইডস সচেতনমূলক প্রচুর বিজ্ঞাপন দেখি। এইডস নিয়ে এতো প্রচার!? প্রতিবন্ধী মানুষের জন্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে আমাদের শক্তিশালী গণমাধ্যমগুলোতে নাটক-বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এমন কিছু কি প্রচার করা যায় না? যা দেখে, শুনে আমাদের দেশের প্রতিটি মানুষই ভাবতে বাধ্য হয়, তাদের ঘরেও একজন প্রতিবন্ধী থাকতে পারতো......আর যদিবা থাকতো তাদের সাথে কেমন ব্যবহার করা উচিৎ--কেমন করে কথা বলা উচিৎ......আমরাও পারি পড়ালেখা করে আর দশজন সুস্থ ছেলেমেয়ের সাথে কাধেঁ কাধঁ মিলিয়ে দেশ গড়ার কাজে অংশ নিতে। এটুকু যদি দেশের সাধারণ মানুষ অনুভব করতে পারে এবং সচেতন হয়ে উঠে তাতেই হয়তো প্রতিবন্ধী মানুষেরা স্বাভাবিক জীবন-যাপনের প্রয়োজনীয় পরিবেশটুকু পাবে।


তাই আপনার কাছে আমার আকুল আবেদন, আমাদের জন্য এমন কিছু করুন যাতে আমার মতো প্রতিবন্ধীরা আবারো স্বপ্ন দেখার সাহস অর্জন করে। কিছু একটা অবলম্বন করে বাঁচার সুযোগ পায়।

আপনার ভালো এবং সুস্থতাই কাম্য।

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার সমৃদ্ধি কামনায়।


বিনীত,

লেখক: সাবরিনা সুলতানা,

সভাপতি, বি-স্ক্যান,চট্টগ্রাম।

Email: sabrina@b-scan.org

 
Design by Oronno Anam | Bloggerized by Salma Mahbub