বেশ কিছুদিন আগে এক সন্ধ্যায় পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে দেখতে গিয়েছিলাম প্রতিবন্ধী শিশুদের আয়োজনে এক ব্যতিক্রমী সাংস্কৃতিক উৎসব। সারাদিনের বৈরী আবহাওয়ায় অনিশ্চিয়তার মাঝে দোদুল্যমান থেকে অবশেষে সেখানে পৌঁছুতে পেরে ভীষণ ভাল লাগছিল। এদেশের একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী হওয়ার অভিশাপে জীবনের সিংহভাগ চলে গেছে চারদেয়ালের মাঝে বন্দী থেকে। তাই এই প্রথম সামনা-সামনি কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখার উত্তেজনা একটু বেশীই ছিল।
শুরুতেই বক্তব্য রাখলেন বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার নেতারা। শুনতে ভালই লাগলো তাদের নিজ নিজ অভিজ্ঞতার আলোয় অলংকৃত কিছু কথা,বক্তব্য। মন্ত্রীমহদয়ের বক্তব্যটি অবশ্য শুনতে হল অনুষ্ঠানের মাঝে,কারণ উনার সংসদ শেষ করে এসে পৌঁছতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল। অনেক শিশুই দেখলাম আয়োজনে, যাদের দেখলেই বুকের ভিতরটি হু হু করে উঠে। এ যেন এক অন্য জগৎ,তাদের কেউ হয়তো দেখেনি এই পৃথিবীর স্বাভাবিক রূপ-রস- আলো। আবার কেউ হয়তো এক সময় অন্য আরো দশটি শিশুর মতোই স্বাভাবিকভাবে জন্মেছিলো, বেড়ে উঠছিলো; কিন্তু কোন দূ্র্ঘটনা বা অসুস্থতা কেড়ে নিয়েছে তাদের দু’চোখের আলো বা করে দিয়েছে তাদের চলৎ শক্তিহীন। আর একদল যাদের কলকালিতে মুখর হবার কথা চারিদিক অথচ তারা কথা বলছে ইশারা ভাষায়,কারণ তারা কথা বলতে পারে না, শুনতে পারে না নিজের গাওয়া গানটিও বা জানে না যেই ছন্দে তারা নেচে যাচ্ছিল সেটিই বা কোন সুর মূর্ছনায় ঝংকিত হচ্ছে? বুদ্ধী প্রতিবন্ধী বা অটিস্টিক শিশুগুলো কি ওদের জগত থেকে বেড়িয়ে আসতে পারছিল? যেই ফুটফুটে শিশুগুলো বসে ছিল হুইলচেয়ারে, কেমন লাগছিলো ওদের, যখন ওদেরই সমবয়সী কিছু শিশু ছুটে বেড়াচ্ছিল মিলনায়তন জুড়ে? আরও অনেক ধরণের প্রতিবন্ধী শিশু সেখানে ছিল যাদের বর্ণনা দেবার ভাষা আমার ঠিক জানা নেই।
এই দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের ঘরের বাইরে একা একা চলাফেরা করা দুঃসাধ্য। বিশেষ করে যারা শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষ, কোথাও বেরুলে বা কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেলে প্রথমেই বিপত্তি ঘটে হুইলচেয়ারের জন্য ঢালু যে চলার পথ থাকা প্রয়োজন, সেটি নিয়ে। একেকটি সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে হুইল চেয়ার সমেত একা বা কোনো সাহায্যকারী নিয়ে অনুষ্ঠানে যাওয়া ঠিক কতটুকু কষ্টসাধ্য তা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা অনেকটাই দু:সাধ্য। তো গত মঙ্গলবার, ৬ অক্টোবর পাবলিক লাইব্রেরির ওই অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছিলো ন্যাশনাল ফোরাম অব অর্গনাইজেশেনস ওয়ার্কিং উইথ দ্য ডিসএবেল্ড (এন,এফ,ও,ডব্লিউ,ডি) নামে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। 'শিশু শিক্ষা সপ্তাহ' উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক শিশু মিলনমেলা। উদ্দেশ্য যদিও ছিল প্রতিবন্ধী শিশুদের সাথে যারা প্রতিবন্ধী নয়, এমন শিশুদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া, কিন্তু নিজেদের মাঝে ভাব বিনিময়ের কোন সুযোগ এই শিশুদের ঘটে নি, আশা করছি ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই হবে, আর তাহলেই এই অনুষ্ঠানগুলো আরও বেশী সাথর্ক হয়ে উঠবে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ এসেছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। বাংলাদেশী সিস্টেমস চেঞ্জ এডভোকেসি নেটওয়ার্ক (বি-স্ক্যান) গোষ্ঠীর সকল সদস্যসহ আমিও আমন্ত্রিত ছিলাম সেখানে। একটু আগে প্রতিবন্ধীদের সহজেই চলাফেরার যে বাধা-বিপত্তিটুকুর কথা বলছিলাম, সম্ভবত এ কারণেই ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতদের মধ্যে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা ছিলো তুলনামূলকভাবে অনেক কম। কারণ আমি দেখেছি মিলনায়তন পর্যন্ত পৌঁছুতে কিছু দূর পর পর দু’টি/তিনটি করে সিঁড়ি পাড় হতে হয়েছে,কিন্তু নেই কোন ঢালু পথ বা র্যাম্প (Ramp)। তাই আমারও লেগেছে তিন/চারজন সাহায্যকারী। ধন্যবাদ জানাই যারা আমায় সাহায্য করেছেন সেই সিঁড়িগুলো পার হতে। জানতে পারলাম, লাইব্রেরী কর্তৃপক্ষ এই বছরের শেষে সেখানে র্যাম্প তৈরীর সিদ্ধান্ত ( বর্তমানে সেখানে র্যাম্প তৈরী হয়ে গেছে) নিয়েছেন। যদি সত্যিই তারা সেটা করেন তাহলে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের দেখে নিশ্চয়ই উৎসাহিত হবেন এই কাজে।
যাই হোক, উপভোগ করলাম প্রতিবন্ধী শিশুদের পরিবেশিত নাচ,গান,কিছু বক্তব্যধর্মী নাট্যাংশ। একটি নাট্যাংশ আমার বিশেষ ভাল লেগেছে, যাতে তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবন্ধী শিশুদের স্কুলে যাওয়ার ব্যপারটি। যেমন একই স্কুলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সাথে পড়তে গেলে শিক্ষকদের কি ধরণের প্রশিক্ষন থাকা প্রয়োজন এবং কি ধরণের সরঞ্জাম থাকা দরকার। আরও কিছু ব্যপারও এখানে তুলে আনা হয়েছে সুন্দরভাবে, যেমন সহপাঠীদের কেউ কেউ তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করছে, আবার কেউ কেউ তাদের বন্ধুও হচ্ছে। অনেক শিক্ষক তাদের পড়াতে বিরক্তবোধ করছেন, আবার অনেক শিক্ষক এক একজন প্রতিবন্ধীকে সাহায্য করার জন্য সহপাঠী ঠিক করে দিচ্ছেন। যে কথাটি আমাকে নতুনভাবে ভাবিয়েছে,তাহলো একজন প্রতিবন্ধী শিশুর সাথে কি করে একজন সাধারন ছাত্রের বন্ধুত্ত গড়ে উঠতে পারে। নাটকটির এক পর্যায়ে একজন ছাত্র বলে উঠে, ‘’ওরাতো (প্রতিবন্ধীরা) আলাদা স্কুলে পড়তে গেলেই পারে’’। তখন একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশু চিৎকার করে উঠে, “না না আমরা আলাদা স্কুলে পড়তে চাই না। আমাদের আলাদা করে দিও না। আমরা তোমাদের সাথে পড়তে চাই।'' তখন আমি সত্যি চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নি। এ যেন আমাদেরই চাঁপা কান্নার বর্হির প্রকাশ। আমরা তো আসলেও আলাদা হতে চাই না। আমরা যে তোমাদেরই একজন।
- সালমা মাহবুব
১১ ডিসেম্বর ২০০৯, জনকন্ঠ।
শুরুতেই বক্তব্য রাখলেন বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার নেতারা। শুনতে ভালই লাগলো তাদের নিজ নিজ অভিজ্ঞতার আলোয় অলংকৃত কিছু কথা,বক্তব্য। মন্ত্রীমহদয়ের বক্তব্যটি অবশ্য শুনতে হল অনুষ্ঠানের মাঝে,কারণ উনার সংসদ শেষ করে এসে পৌঁছতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল। অনেক শিশুই দেখলাম আয়োজনে, যাদের দেখলেই বুকের ভিতরটি হু হু করে উঠে। এ যেন এক অন্য জগৎ,তাদের কেউ হয়তো দেখেনি এই পৃথিবীর স্বাভাবিক রূপ-রস- আলো। আবার কেউ হয়তো এক সময় অন্য আরো দশটি শিশুর মতোই স্বাভাবিকভাবে জন্মেছিলো, বেড়ে উঠছিলো; কিন্তু কোন দূ্র্ঘটনা বা অসুস্থতা কেড়ে নিয়েছে তাদের দু’চোখের আলো বা করে দিয়েছে তাদের চলৎ শক্তিহীন। আর একদল যাদের কলকালিতে মুখর হবার কথা চারিদিক অথচ তারা কথা বলছে ইশারা ভাষায়,কারণ তারা কথা বলতে পারে না, শুনতে পারে না নিজের গাওয়া গানটিও বা জানে না যেই ছন্দে তারা নেচে যাচ্ছিল সেটিই বা কোন সুর মূর্ছনায় ঝংকিত হচ্ছে? বুদ্ধী প্রতিবন্ধী বা অটিস্টিক শিশুগুলো কি ওদের জগত থেকে বেড়িয়ে আসতে পারছিল? যেই ফুটফুটে শিশুগুলো বসে ছিল হুইলচেয়ারে, কেমন লাগছিলো ওদের, যখন ওদেরই সমবয়সী কিছু শিশু ছুটে বেড়াচ্ছিল মিলনায়তন জুড়ে? আরও অনেক ধরণের প্রতিবন্ধী শিশু সেখানে ছিল যাদের বর্ণনা দেবার ভাষা আমার ঠিক জানা নেই।
এই দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের ঘরের বাইরে একা একা চলাফেরা করা দুঃসাধ্য। বিশেষ করে যারা শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষ, কোথাও বেরুলে বা কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেলে প্রথমেই বিপত্তি ঘটে হুইলচেয়ারের জন্য ঢালু যে চলার পথ থাকা প্রয়োজন, সেটি নিয়ে। একেকটি সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে হুইল চেয়ার সমেত একা বা কোনো সাহায্যকারী নিয়ে অনুষ্ঠানে যাওয়া ঠিক কতটুকু কষ্টসাধ্য তা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা অনেকটাই দু:সাধ্য। তো গত মঙ্গলবার, ৬ অক্টোবর পাবলিক লাইব্রেরির ওই অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছিলো ন্যাশনাল ফোরাম অব অর্গনাইজেশেনস ওয়ার্কিং উইথ দ্য ডিসএবেল্ড (এন,এফ,ও,ডব্লিউ,ডি) নামে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। 'শিশু শিক্ষা সপ্তাহ' উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক শিশু মিলনমেলা। উদ্দেশ্য যদিও ছিল প্রতিবন্ধী শিশুদের সাথে যারা প্রতিবন্ধী নয়, এমন শিশুদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া, কিন্তু নিজেদের মাঝে ভাব বিনিময়ের কোন সুযোগ এই শিশুদের ঘটে নি, আশা করছি ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই হবে, আর তাহলেই এই অনুষ্ঠানগুলো আরও বেশী সাথর্ক হয়ে উঠবে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ এসেছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। বাংলাদেশী সিস্টেমস চেঞ্জ এডভোকেসি নেটওয়ার্ক (বি-স্ক্যান) গোষ্ঠীর সকল সদস্যসহ আমিও আমন্ত্রিত ছিলাম সেখানে। একটু আগে প্রতিবন্ধীদের সহজেই চলাফেরার যে বাধা-বিপত্তিটুকুর কথা বলছিলাম, সম্ভবত এ কারণেই ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতদের মধ্যে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা ছিলো তুলনামূলকভাবে অনেক কম। কারণ আমি দেখেছি মিলনায়তন পর্যন্ত পৌঁছুতে কিছু দূর পর পর দু’টি/তিনটি করে সিঁড়ি পাড় হতে হয়েছে,কিন্তু নেই কোন ঢালু পথ বা র্যাম্প (Ramp)। তাই আমারও লেগেছে তিন/চারজন সাহায্যকারী। ধন্যবাদ জানাই যারা আমায় সাহায্য করেছেন সেই সিঁড়িগুলো পার হতে। জানতে পারলাম, লাইব্রেরী কর্তৃপক্ষ এই বছরের শেষে সেখানে র্যাম্প তৈরীর সিদ্ধান্ত ( বর্তমানে সেখানে র্যাম্প তৈরী হয়ে গেছে) নিয়েছেন। যদি সত্যিই তারা সেটা করেন তাহলে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের দেখে নিশ্চয়ই উৎসাহিত হবেন এই কাজে।
যাই হোক, উপভোগ করলাম প্রতিবন্ধী শিশুদের পরিবেশিত নাচ,গান,কিছু বক্তব্যধর্মী নাট্যাংশ। একটি নাট্যাংশ আমার বিশেষ ভাল লেগেছে, যাতে তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবন্ধী শিশুদের স্কুলে যাওয়ার ব্যপারটি। যেমন একই স্কুলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সাথে পড়তে গেলে শিক্ষকদের কি ধরণের প্রশিক্ষন থাকা প্রয়োজন এবং কি ধরণের সরঞ্জাম থাকা দরকার। আরও কিছু ব্যপারও এখানে তুলে আনা হয়েছে সুন্দরভাবে, যেমন সহপাঠীদের কেউ কেউ তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করছে, আবার কেউ কেউ তাদের বন্ধুও হচ্ছে। অনেক শিক্ষক তাদের পড়াতে বিরক্তবোধ করছেন, আবার অনেক শিক্ষক এক একজন প্রতিবন্ধীকে সাহায্য করার জন্য সহপাঠী ঠিক করে দিচ্ছেন। যে কথাটি আমাকে নতুনভাবে ভাবিয়েছে,তাহলো একজন প্রতিবন্ধী শিশুর সাথে কি করে একজন সাধারন ছাত্রের বন্ধুত্ত গড়ে উঠতে পারে। নাটকটির এক পর্যায়ে একজন ছাত্র বলে উঠে, ‘’ওরাতো (প্রতিবন্ধীরা) আলাদা স্কুলে পড়তে গেলেই পারে’’। তখন একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশু চিৎকার করে উঠে, “না না আমরা আলাদা স্কুলে পড়তে চাই না। আমাদের আলাদা করে দিও না। আমরা তোমাদের সাথে পড়তে চাই।'' তখন আমি সত্যি চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নি। এ যেন আমাদেরই চাঁপা কান্নার বর্হির প্রকাশ। আমরা তো আসলেও আলাদা হতে চাই না। আমরা যে তোমাদেরই একজন।
- সালমা মাহবুব
১১ ডিসেম্বর ২০০৯, জনকন্ঠ।
1 মন্তব্য(সমূহ):
Vashahin!
Post a Comment