হার না-মানা দুই ছাত্রী

ওদের একজন মুখ দিয়ে লিখছে, অন্যজন ডান পা দিয়ে। অদম্য এক মানসিক শক্তি নিয়ে ওরা দুজন পশ্চিমবঙ্গে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। ওরা কলকাতার অদূরে হাওড়া জেলার কুলগাছিয়ার শ্রীরামপুর গ্রামের সুভদ্রা ভৌমিক আর উত্তর চবি্বশ পরগনা জেলার বারাসাত ভারপাড়ার নাসিমা খাতুন। অন্যসব স্বাভাবিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে পরীক্ষায় বসে এ দুজন দেখিয়ে দিয়েছে তাদের মনের জোর কতটা অপ্রতিরোধ্য।
গত মঙ্গলবার থেকে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের আওতায় মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। গোটা রাজ্যে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা নয় লাখ ৪৭ হাজার ৪৯৫ জন। গত বছর থেকে এবার পরীক্ষার্থী ৯৪ হাজার বেশি। কলকাতা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে হাওড়ার শ্রীরামপুর কুলগাছিয়া বাঙালপুর জ্যোর্তি গালর্স স্কুলের ছাত্রী সুভদ্রা ভৌমিক। জন্ম থেকেই সুভদ্রার দুটি হাত নেই। ছোট বেলায় অন্যদের লিখতে দেখে তারও ইচ্ছা জাগে লেখাপড়া শেখার। তখন থেকে সে পা দিয়ে লিখতে শুরু করে। এরপর স্কুলে ভর্তি করানো হলে একে একে প্রতিটি ক্লাসে ভালো নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয় সুভদ্রা ভৌমিক।

উত্তর চবি্বশ পরগনার বারাসাতের বিবেকানন্দ আদর্শ বিদ্যাপীঠের ছাত্রী নাসিমা খাতুনের কাহিনী একটু অন্যরকম। নাসিমা জন্ম নিয়েছিল আর দশটা স্বাভাবিক শিশুর মতোই। কিন্তু জন্মের পাঁচ-ছয় বছর পর পোলিও আক্রান্ত হয়ে তার দুটি হাত নষ্ট হয়ে যায়। পড়ালেখার জন্য উদ্যম আর মানসিক শক্তি প্রতিমুহূর্তে সে বাবা-মায়ের কাছ থেকে পেয়ে এসেছে।

'নাসিমা প্রতিবন্ধী', 'ওর হাত নেই'_ প্রতিবেশীদের মুখে এমন নানা ধরনের নেতিবাচক কথা শুনে তার ভেতরে জেদ চাপতে থাকে। মুখ দিয়ে লেখার অভ্যাস গড়ে তোলে সে। স্কুলে ভর্তি হয়ে সেও একে একে সব ক্লাসে ভালো ফল করে।

জীবন নিয়ে যাদের প্রতিদিন পরীক্ষা দিতে হয়, তাদের স্কুলের পরীক্ষাকে এতটা গুরুত্ব দিতে নারাজ দুই প্রতিবন্ধী ছাত্রীর অভিভাবক। সুভদ্রার বাবা প্রবোধ ভৌমিক জানালেন, মেয়ের দুহাত নেই বলে মানুষ নানা কথা বলে। 'কিভাবে ওকে বিয়ে দেব?', 'কেউ কি ওকে বিয়ে করবে?' এসব শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা। প্রতিদিন মেয়ের সঙ্গে তাঁরাও যেন জীবনপরীক্ষা দিচ্ছেন। তাঁর মেয়ে হয়ত ভালো রেজাল্ট করবে। কিন্তু তাতে কি সমাজের মানুষের মনোভাব পাল্টাবে?

মেয়ে প্রতিবন্ধী বলে নিজের আত্দীয়স্বজনদের কাছ থেকেই প্রতিনিয়ত কথা শুনতে হয় নাসিমা আক্তারের দিনমজুর বাবা আজাদ আলীকে। তাই মেয়ের এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া তাঁর কাছে খুব একটা নতুন কিছু নয়। আজাদ আলী বলেন, 'প্রতিদিন আমার মেয়েকে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে সমাজব্যবস্থার কাছে। খাতা-কলমের পরীক্ষা আবার নতুন কী।'

কালের কন্ঠ, ২৮ ফেব্রুয়ারী,২০১০।
http://www.dailykalerkantho.com/?view=details&type=single&pub_no=90&cat_id=1&menu_id=60&news_type_id=1&index=2

0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment

 
Design by Oronno Anam | Bloggerized by Salma Mahbub