দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার

আমি ভয়াবহ এক রোগে আক্রান্ত। চলাফেরার ক্ষমতা হারিয়েছি ছোটবেলায়ই। যতদিন হেঁটেছি মানুষের তীর্যক চাহনি সহ্য করতে হয়েছে। আঁকাবাঁকা করে হাঁটতাম, কখনও কখনও হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতাম। মানুষ হাঁ করে তাকিয়ে থাকত যেন আমি তাদের মতো মানুষ নই, এক আজব জন্তু। ভবিষ্যৎ চিন্তা না করেই বাবা-মা একদিন আচমকা বলে বসলেন, 'কাল থেকে স্কুলে যেয়ো না, ঘরেই পড়াশোনা করো।' ঘরে নিজে নিজে কতটুকুই-বা পড়া হতো! ডুবে গেলাম গল্প, উপন্যাস টিভি আর কল্পনার জগতে। বন্ধ হয়ে গেল আত্মীয়স্বজনের বিয়ে, আচার অনুষ্ঠানে যাওয়া। আমি বা আমার মতো অবস্থায় যারা আছে, তাদের জন্য কে দায়ী, কাকে দায়ী করব আমরা? আমাদের অভিভাবককে না এই সমাজ ব্যবস্থাকে?

বাংলাদেশে এক-দশমাংশ মানুষ (২৪ বছর আগের জরিপ মতে যা প্রায় দেড় কোটি, এরপর সরকারিভাবে আর কোনো জরিপ হয়নি) বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা নিয়ে সমাজব্যবস্থা থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বসবাস করছে। এদের মধ্যে প্রায় ৩২% দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, ২৮% শারীরিক প্রতিবন্ধী, ২২% বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী, ৭% বুদ্ধি প্রতিবন্ধী আর বাকি ১১% বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার। তাদের বেরিশভাগই বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।
দৃষ্টি, বাক ও শ্রবণ এবং বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রয়োজনের তুলনায় খুবই স্বল্পসংখ্যক বিশেষ স্কুল থাকলেও শারীরিক প্রতিবন্ধীরা না পারে বিশেষ স্কুলে যেতে, না পায় স্বাভাবিক স্কুলে যাওয়ার যথাযথ পরিবেশ। কারণ স্বাভাবিক স্কুলে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য যে ঢালু বা র‌্যাম্প থাকার কথা তা কিছুসংখ্যক সরকারি স্কুল এবং ঢাকায় দু'একটি বেসরকারি স্কুল ছাড়া কোথাও নেই।
প্রতিবন্ধীদের সব কিছুতেই হয়ে যায় 'না'। বিয়ে বাড়ি 'না'। জন্মদিন বা বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠান 'না'। স্কুল,-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় 'না'। পাবলিক বাস বা ট্রেন 'না'। বিনোদন কেন্দ্র বা খেলার মাঠ তাতেও 'না'। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এই না-এর আবর্তে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধীরা।
বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষই কেন এমন করে ভাবতে পারেন না, তাদের ঘরেও একজন প্রতিবন্ধী থাকতে পারত! আর যদি থাকত তাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা প্রয়োজন... করুণা নয়, একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও পারে রাষ্ট্রের দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত হতে। এর জন্য প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা। আমাদের গণমাধ্যম এবং সুশীল সমাজ এতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক তথ্য সাধারণ মানুষের কাছে পেঁৗছে দেওয়া গেলে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবার ও সমাজ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যথাযথ মূল্যায়ন করবে। সমাজ তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ দেবে। রাষ্ট্র ও সমাজের নৈতিক দায়িত্ব প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করা এবং তাদের প্রাপ্য অধিকারকে 'না' না বলে 'হ্যাঁ' বলতে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তোলা। তাহলেই তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা তৈরি হবে এবং তারা নিজেদের এই সমাজের বোঝা ভাববে না।

লেখকঃ সাবরিনা সুলতানা, ৬ ফেব্রুয়ারী ২০১০, দৈনিক সমকাল।
http://www.samakal.com.bd/details.php?news=42&action=main&menu_type=&option=single&news_id=45278&pub_no=241&type=

0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment

 
Design by Oronno Anam | Bloggerized by Salma Mahbub