অবশেষে হচ্ছে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা নীতিমালা

প্রতিবন্ধী শিশুদের সাধারণ স্কুলে ভর্তির সরকারি নীতিমালা হচ্ছে। তিন বছর ধরে প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নানা উদ্যোগ চলছে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ছাড়াই। নীতিমালা না থাকায় প্রতিবন্ধী শিশুদের সাধারণ স্কুলে ভর্তির কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। উপরন্তু প্রতিবন্ধীদের ভর্তি করতে গিয়ে স্কুলগুলোও পড়ছে নানা বিভ্রান্তিতে। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত প্রতিবন্ধী দিবসের অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেছেন, প্রতিবন্ধীদের সাধারণ স্কুলে ভর্তি করতে অনিচ্ছুক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রতিবন্ধী শিশুদের সাধারণ স্কুলে লেখাপড়ার বিষয়ে এত দিনেও সরকারি নীতিমালা তৈরি হয়নি। তবে শিগগিরই এ নীতিমালা তৈরি করা হবে। তিনি জানান, নীতিমালা তৈরি করতে আজ শুক্রবার থেকে সারা দেশে শিশু ও সাক্ষরতা বিষয়ে পাঁচ দিনব্যাপী জরিপ পরিচালিত হবে। এ জরিপে প্রতিবন্ধী শিশুদের সংখ্যা এবং কে কোন ধরনের প্রতিবন্ধী তা চিহ্নিত করা হবে। জরিপে চিহ্নিত প্রতিবন্ধীদের মধ্যে যারা সাধারণ স্কুলে পড়তে সক্ষম, তাদের সাধারণ স্কুলেই ভর্তি করা হবে। আর গুরুতর প্রতিবন্ধীদের ভর্তি করা হবে সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত বিশেষ স্কুলে।
দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বছর তিনেক ধরে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে 'একীভূত শিক্ষা' কর্মসূচির আওতায় গুরুতর প্রতিবন্ধী ছাড়া সাধারণ ও মাঝারি ধরনের প্রতিবন্ধী শিশুদের সাধারণ স্কুলে ভর্তি করতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এত বছরেও এ জন্য সরকার কোনো নীতিমালা তৈরি করেনি। ফলে স্কুলগুলো প্রতিবন্ধীদের ভর্তির ক্ষেত্রে নানা বিভ্রান্তিতে পড়ছে। প্রতিবন্ধীদের সাধারণ স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই। এ ছাড়া প্রতিবন্ধীদের লেখাপড়া অব্যাহত রাখতে স্কুলগুলোর কিছুটা অবকাঠামোগত পরিবর্তনও দরকার। এর জন্যও সরকারি নীতিমালা প্রয়োজন।
প্রতিবন্ধীদের স্বেচ্ছাসেবা দিয়ে থাকে বি-স্ক্যান (বাংলাদেশি সিস্টেমস চেঞ্জ অ্যাডভোকেসি নেটওয়ার্ক)। সংগঠনের সহকারী প্রশাসক সালমা মাহবুব তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারি নীতিমালার অভাবে বহু বছর ধরে প্রতিবন্ধীরা সাধারণ স্কুলে পড়তে গিয়ে নানা সমস্যায় পড়ছে। সরকারি নীতিমালা থাকলে দৃষ্টি, চলৎ, বাক ও শ্রবণ_এই চার ধরনের মধ্যমমানের প্রতিবন্ধী শিশুরা কোন পদ্ধতিতে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই লেখাপড়া করতে পারবে এবং তাদের জন্য কী কী উপকরণের প্রয়োজন হতে পারে, তা স্পষ্ট হতো। প্রতিবন্ধী ছেলে-মেয়েদের সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করতে স্কুলগুলোরও তৈরি হতো বাধ্যবাধকতা। কিন্তু এর অভাবে সর্বত্র বিপত্তি দেখা দিচ্ছে।
সালমা মাহবুব উদাহরণ দিয়ে বলেন, চলতি জানুয়ারিতেই চট্টগ্রামের রেসিডেন্সিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একজন চলৎ প্রতিবন্ধী ছাত্রী সপ্তম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হয়। কিন্তু তার নতুন শ্রেণীকক্ষটি ছিল দোতলায়; ফলে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে তার ক্লাস করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। প্রয়োজনীয় সরকারি নীতিমালা না থাকায় তার পড়াশুনা নিয়ে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। পরে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপাধ্যক্ষ উদ্যোগী হয়ে অষ্টম শ্রেণীর ক্লাসটি নিচতলায় নামিয়ে আনায় এ সমস্যার সমাধান হয়।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সাধারণ স্কুলে প্রতিবন্ধী শিশুদের লেখাপড়ার সুযোগ সৃষ্টির জন্য জনসচেতনতা তৈরি করতে 'সবার জন্য শিক্ষা' কর্মসূচির আওতায় ২০০৬ সালে সরকার 'একীভূত শিক্ষা' প্রকল্প গ্রহণ করে। এই প্রকল্পের আওতায় গত তিন বছরে উপজেলা পর্যায়ের সরকারি, আধাসরকারি ও সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ১২৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিনিধিকে (প্রধান শিক্ষক বা সহকারী প্রধান শিক্ষক) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ের আরো ৩৭৯টি একই ধরনের স্কুলের শিক্ষক প্রতিনিধিকে এই প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
এ ছাড়া প্রতিবন্ধীদের স্কুলে ভর্তির জন্য শিক্ষাঙ্গনের অবকাঠামোগত উন্নয়নে একেকটি স্কুলকে ১০ হাজার টাকা প্রাথমিক বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এই টাকায় স্কুলগুলো হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী শিক্ষার্থীর জন্য ঢালু পথ (র‌্যাম্প) নির্মাণ, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য শ্রেণীকক্ষের পাঠ বারবার শোনার জন্য টেপ রেকর্ডার কেনা ইত্যাদি খাতে ব্যয় করবে।
প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০০৯ এবং প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন (সংশোধিত) ২০০৯-এর খসড়ায় গুরুতর প্রতিবন্ধী ছাড়া অন্য প্রতিবন্ধী শিশুদের সাধারণ স্কুলেই লেখাপড়ার সুযোগ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে।
১৯৯০ সালে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শিক্ষা সম্মেলনে ২০০০ সালের মধ্যে সব শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার আহ্বান জানানো হয়। পরে ১৯৯৩ সালে দিল্লীর জনসংখ্যা এবং ২০০০ সালে সেনেগালের ডাকারে অনুষ্ঠিত শিক্ষাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার 'সবার জন্য শিক্ষা' কর্মসূচি গ্রহণ করে। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথে ২০০৬ সালে কন্যা, দরিদ্র, প্রতিবন্ধী ও আদিবাসী_প্রাথমিক শিক্ষাবঞ্চিত এই চার ধরনের শিশুকে 'একীভূত শিক্ষা' কর্মসূচির আওতাভুক্ত করা হয়। আর ২০১১ সালের মধ্যে পুরো কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্য ধরা হয়।
১৯৮৫ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, দেশের প্রায় দেড় কোটি মানুষ নানাভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার; যা মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ। এরপর আর কোনো সরকারি-বেসরকারি জরিপ না হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, বর্তমানে এই সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি।

লেখকঃ বিপ্লব রহমান
http://www.kalerkantho.com/

2 মন্তব্য(সমূহ):

Salma Mahbub said...

ধন্যবাদ বিপ্লব, তোমার চমৎকার প্রতিবেদনের জন্য।

Biplob Rahman said...

thanx. kintu eti 1st pg e aro valo kore aste parto...

Post a Comment

FACEBOOK FACEBOOK AMARBLOG

 
Design by Oronno Anam | Bloggerized by Salma Mahbub