সাতক্ষীরায় প্রতিবন্ধীদের জন্য ইতালীয় দম্পতির মমতার জাল


রাজধানীর কোনো এক ডাস্টবিনের পাশে পড়ে ছিল এক নবজাতক। গর্ভধারিণী মা তাকে ফেলে গেলেও ভাগ্যহত প্রতিবন্ধী শিশুর জন্য বিপুলা পৃথিবী কোল পেতে দিল। ভিনদেশি এক নারী ডাস্টবিনের পাশ থেকে কুড়িয়ে নিলেন তাকে। তারপর সাভারের সিআরপিতে ঠাঁই হয় তার। সেখান থেকে তাকে সাতক্ষীরায় নিয়ে এসে মায়াডোরে বাঁধলেন ইতালীয় দম্পতি এনসো আর লাওরা। কবি যেমন বলেন, 'সেই ছেলে আজ কেমন বড়টি!' কুড়িয়ে পাওয়া সেই শিশু এখন ২৪ বছরের নির্ঝর। অপত্যস্নেহের ঝরনাধারায় স্থায়ী আশ্রয় পেয়েছে সে। নির্ঝর জানে, এনসো আর লাওরাই তার বাবা-মা।

একা নির্ঝর নয়, তার মতো অসংখ্য অসহায় আর প্রতিবন্ধী শিশুর মা-বাবা এখন এনসো দম্পতি। আশ্রিত এসব শিশু পাচ্ছে মমতা আর ভালোবাসা। সমাজের উপেক্ষিত এই প্রতিবন্ধীদের আশ্রয়, চিকিৎসা আর পুনর্বাসনের জন্য সাভার সিআরপির আদলে সাতক্ষীরা শহরের উপকণ্ঠে গোপীনাথপুর গ্রামে এই দুই ভিনদেশি গড়ে তুলেছেন রিশিল্পি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট। অসহায় মানুষের সেবা করতে গিয়ে দু'জন জড়িয়ে পড়েছেন এদেশের মায়ায়। নিবিড়ভাবে মিশে গেছেন এদেশের মাটি আর মানুষের সঙ্গে। এ মায়ার বাঁধন ছিঁড়ে কোনোদিন তারা আর ফিরে যাবেন না ইতালিতে। '...তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও আমি এই বাংলার পাড়ে রয়ে যাবো'_ এখন এনসো দম্পতির শেষ চাওয়া এটাই। মৃত্যুর পর এখানেই সমাধিস্থ হতে চান বলে রিশিল্পির অভ্যন্তরে সমাধির জন্য জায়গাও ঠিক করে রেখেছেন। তারা কথাও বলেন শুদ্ধ বাংলায়। সাতক্ষীরার মানুষ তাদের এনসো-লাওরা বলে চেনে। তাদের একমাত্র পুত্রসন্তান আন্দ্রিয়া ফালকোনে ঢাকায় পড়াশোনা করেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরপরই ভিনসেনজো ফালকোনে ওরফে এনসো স্ত্রী লাওরা মেলানোকে সঙ্গে নিয়ে সুদূর ইতালি থেকে চলে আসেন সাতক্ষীরা শহরে। সমাজের হৃতদরিদ্র মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করতে করতে এক সময় এদেশের মানুষ আর প্রকৃতির মায়ায় জড়িয়ে পড়েন। এক সময় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন সাতক্ষীরায়। শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কের পাশে গোপীনাথপুর গ্রামে রিশিল্পি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট এখন স্নেহবঞ্চিত প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য বিছিয়ে রেখেছে নিশ্চিত আশ্রয়ের ছায়া।


বুধবার দুপুরে রিশিল্পি গেটে পা রাখতেই হুইল চেয়ারে বসা এক প্রতিবন্ধী যুবকের ওপর চোখ পড়ল। সেই হুইল চেয়ারটি ঠেলছেন প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার স্বয়ং ভিনসেনজো ফালকোনে এনসো। 'নাম কী?'_ যুবকের কাছে জানতে চাই। শিশুর মতো আধো আধো বোলে হুইল চেয়ারে বসা শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী যুবকের উত্তর : 'নির্ঝর। বাড়ি এখানে। বাবার নাম এনসো। মায়ের নাম লাওরা।' নির্ঝর তাকে পিতা বলে পরিচয় দিচ্ছে দেখে আনন্দের ঝিলিক খেলে গেল এনসোর মুখে। গর্বে। বুকটা ভরে গেছে তার। গলা জড়িয়ে ধরে আবেগাপ্লুত এনসো তার কুড়িয়ে পাওয়া ছেলেকে আদর বোলালেন। এ সময় এগিয়ে এলেন নার্স দিপালি মণ্ডল। নির্ঝরের জীবনের মর্মন্তুদ কাহিনী জানা গেল তার মুখে। ২৪ বছর আগে ঢাকা শহরে এক ডাস্টবিনের পাশে পড়ে ছিল নবজাতক নির্ঝর। পাশেই ফুটপাত ধরে হাঁটছিলেন এক মার্কিন নারী। এ সময় শিশুর কান্না কানে গেল তার। এগিয়ে গিয়ে দেখলেন ছোট্ট শিশুকে কেউ ফেলে গেছে ডাস্টবিনে। সঙ্গে সঙ্গে কোলে তুলে নিলেন ওকে। ওই মার্কিন নারীর সঙ্গে সাভার সিআরপিতে পরিচয় হয় এনসোর। তারই অনুরোধে ১৯৯৬ সালে এনসো নির্ঝরকে নিয়ে আসেন রিশিল্পি প্রতিবন্ধী শেল্টার হোমে।


নির্ঝরকে বিশেষ পদ্ধতিতে লেখাপড়া শেখানো হয়। নিয়মিত দেওয়া হয় থেরাপি। নির্ঝরের মতো ৮৬ জন প্রতিবন্ধী শিশুকে বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে লেখাপড়া শেখানো হয়। একই শেল্টার হোমে আশ্রিত আবিরের বয়স ১৩। বাড়ি খুলনা শহরের টুটপাড়ায়। সাধারণ শাখায় সে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে সে। যথেষ্ট চটপটে। সে জানায়, তার বাবা নেই, মা আছে। শারীরিক প্রতিবন্ধী বলে তার মা তাকে এখানে রেখে গেছে। ৯ বছর ধরে এনসো আর লাওরার স্নেহে বড় হচ্ছে সে। ১২ বছরের আরেক অভাগা শিশু সোহান। প্রতিবন্ধী সন্তান প্রসব করায় সোহানের মায়ের সঙ্গে তার বাবার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। মায়ের সঙ্গে সোহান শহরতলির বিনেরপোতা গ্রামে নানীর বাড়িতে চলে আসে। কিন্তু বিধিবাম। প্রতিবন্ধী সোহানকে ফেলে রেখে তার মা অন্য এক পুরুষের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। নানীর বাড়ির আশ্রয়টুকুও এক সময় টলে যেতে থাকে। এমনই সময় তার ঠাঁই হয় রিশিল্পি শেল্টার হোমে।
শহরের ইটাগাছার জাহিদের মা ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালান। প্রতিবন্ধী সন্তানের চিকিৎসার খরচ জোগানোর সাধ্য তার নেই। জাহিদেরও আশ্রয় মিলেছে এখানে। আরও এক হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান ৮ বছরের রানা। সে কথা বলতে পারে না। কমিউনিকেশন বোর্ডের মাধ্যমে তাকে কথা বলানো হয়। এই প্রতিবন্ধী শিশুদের চিকিৎসার পাশাপাশি লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্বে আছেন কয়েকজন শিক্ষক। তাদেরই একজন প্রভা মণ্ডল। তিনি নিজেও একজন প্রতিবন্ধী। স্বামী শ্যামল মণ্ডলও ছিলেন শারীরিক প্রতিবন্ধী। দিন কয়েক আগে প্রভা মণ্ডল বিধবা হয়েছেন। কিন্তু এই প্রতিবন্ধী শিশুদের সানি্নধ্যে তিনি স্বামী শোক কাটিয়ে উঠেছেন।


রিশিল্পি ছাড়াও একই প্রতিষ্ঠান তালা, কলারোয়া, খুলনা ও আশাশুনিতে প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসা ও শিক্ষা নিশ্চিত করেছে। ফিজিওথেরাপিস্ট শংকর কুমার ঢালী জানালেন, প্রতিবন্ধীদের ম্যানুয়ালি ও ইলেক্ট্রোথেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এরপর রয়েছে তাদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা। কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে এই প্রতিবন্ধীদের জীবিকা অর্জনে সক্ষম ও স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলছেন এনসো। প্রতিবন্ধী শিশু সাথীকে দেখিয়ে নার্স পূর্ণিমা বললেন, তার নিজের কোনো একাডেমিক শিক্ষা না থাকলেও বিশেষ প্রশিক্ষণের সুবাদে তিনি এই প্রতিবন্ধী শিশুদের সেবা করতে পারছেন। দিপালি বললেন, সাথী যেদিন কথা বলতে ও হাঁটতে পারবে, সেদিনই তার শ্রম সার্থক হবে।


১৯৭২ সালে শহরের সুলতানপুর মিশনারি চার্র্চে এনসোর সঙ্গে পরিচয় হয় নির্মল দাসের। এনসোর সঙ্গে নির্মলের সম্পর্ক আজও অটুট। তিনি জানালেন, সাদা চামড়ার মানুষ এনসোকে দেখে তার কাছে অগণিত মানুষ প্রতিদিন ভিক্ষার জন্য ভিড় করত। এনসো তার সাধ্যমতো ভিক্ষা দিত। কিন্তু তার উপলব্ধি হলো, এভাবে ভিক্ষা দিয়ে তো মানুষকে বাঁচানো যায় না। তাই এসব হতদরিদ্র মানুষকে কারিগরি জ্ঞান ও হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দিয়ে জীবিকার বিকল্প সন্ধান করে দিতে শুরু করলেন। ১৯৭৭ সালে গড়ে তুললেন রিশিল্পি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট। শেল্টার হোমে প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসার পর তাদের টেইলারিং, লেদার ও উড সেকশনে কাজের সুযোগ করে দেওয়া হয়। তাদের হাতে তৈরি পণ্য রফতানি করা হয় উন্নত বিশ্বে। প্রচারবিমুখ এনসো বলেন, 'অসহায় মানুষের সেবা করে তৃপ্তি পাই। জীবনের বাকি দিনগুলো ওদের নিয়েই কাটাতে চাই। স্ত্রী লাওরা কিছুটা অসুস্থ। তাই সে বিশ্রাম নিচ্ছে। মৃত্যুর পর এখানেই সমাহিত হতে চাই।' এদেশের মাটি আর মানুষের চোখের আলোয়, বুকের কাছাকাছি থাকার আতীব্র আকাঙ্ক্ষা তার মনকে হাওয়া দেয় নিয়ত। বুঝিবা এটাই তার দেশ, তার দ্বিতীয় জন্মভূমি! বুঝিবা তার মনেও ঘুরছে এই দুর্মর ইচ্ছা : 'তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও/আমি এই বাংলার পাড়ে রয়ে যাব।'
 

তথ্যসূত্রঃ রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী, সাতক্ষীরা  দৈনিক সমকাল।
http://www.samakal.com.bd/details.php?news=14&action=main&menu_type=&option=single&news_id=37646&pub_no=206&type=

0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment

FACEBOOK FACEBOOK AMARBLOG

 
Design by Oronno Anam | Bloggerized by Salma Mahbub