কিছু সচেতনতা সবার জন্য

কোনো দুর্ঘটনা বা অসুস্থতা জনিত কারণে যে কেউ যখন-তখন প্রতিবন্ধিতার স্বীকার হতে পারেন!

একজন প্রতিবন্ধী মানুষেরও রয়েছে শিক্ষা, চাকরি, চিকিৎসা, বাসস্থান, বিনোদনসহ সব ধরণের মৌলিক-মানবিক অধিকার। জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী অধিকার রক্ষা সনদ তৈরী হয়েছে। বাংলাদেশও ২০০৭ সালের ৩০ নভেম্বর এই সনদে সাক্ষর করেছে।

প্রতিবন্ধী মানুষেরা এই সমাজেরই একজন। তাদেরকে মূল জনস্রোত থেকে আলাদা করে দেবেন না। তাদেরও অধিকার রয়েছে এ দেশের শিক্ষা, রাজনীতি, অর্থনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার। দয়া বা করুণা নয়, তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন। ভেবে দেখুন, আজ আপনার ঘরেও একজন প্রতিবন্ধী মানুষ থাকতে পারতো।। কে বলতে পারে, কোনো দুর্ঘটনা বা অসুস্থতার কারণে যে কোনো সময় আপনি বা আপনার নিকট কোনো স্বজন যে তাদেরই একজন হবেন না?

তাই সময় থাকতে আসুন, আমরা দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রতিবন্ধী মানুষের পাশে এসে দাঁড়াই। তাদের মৌলিক মানবিক অধিকার আদায়ে সোচ্চার হই।

প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য কিছু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার নিশ্চিত করলে তারা একাই সহজ-স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবেন। উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালেই আমরা এর প্রমাণ পাই। এমন কোন কাজ নেই যা তারা করছেন না। আমাদের দেশে উন্নত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হলে প্রতিবন্ধীদের জন্য জীবন যাপন অনেক সহজ হবে। কিন্তু তাই বলে বসে থাকলে চলবে না।

আমরা যা করতে পারি, তা হচ্ছে-- প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সাধ্যমত প্রতিবন্ধী মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি। আর আমাদের দেশের অনেক আইনও এ বিষয়টি সমর্থণ করে। এসব আইনি অধিকার বাস্তবায়িত হলে প্রতিবন্ধীদের আজকের এই পরনির্ভরশীল জীবন কাটাতে হয় না।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা আইন ২০১০ তৈরীর জন্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদের আশা, এই আইনটির যথাযথ বাস্তবায়ন।

বাংলাদেশের ’স্যোশাল অ্যাসিসটেন্স অ্যান্ড রিহ্যাবিলেটেশন্স ফর দা ফিজিক্যালি ভারনারেবল’ (এসএআরপিভি)-এর চীফ এক্সিকিউটিভ জনাব শহিদুল হকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশী ৩৩.৭%, তারপরই শারীরিক প্রতিবন্ধীদের অবস্থান ২৪.৪%। এছাড়া অন্যান্যদের মাঝে আছে কুষ্ঠ

অটিজেম বা বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য বিশেষ ধরণের স্কুলের প্রয়োজন হয়। এ দেশে অল্প কয়েকটি এ ধরণের বিশেষ স্কুল আছে। কিন্তু যারা শারীরিক প্রতিবন্ধী, তারাই রয়েছেন সবচেয়ে সমস্যা-সঙ্কুল অবস্থায়। কারণ তারা না পারছে প্রতিবন্ধীদের বিশেষ স্কুলে যেতে; আবার না পারছে সাধারণ স্কুলে পড়তে।।

কী করলে এ ধরণের মানুষগুলো ঘর থেকে বের হয়ে মিশতে পারবে সমাজে, আসুন, আমরা তাই দেখি:

*প্রথমেই যা প্রয়োজন, তা হল পরিবারের সহযোগিতা। অন্য স্বাভাবিক সন্তানটির মত প্রতিবন্ধী সন্তানটিরও রয়েছে শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদন, ভালবাসাসহ সব ধরণের পারিবারিক অধিকার--এ কথা অভিভাবক ও পরিবারের সদস্যদের বুঝতে হবে।

*আপনি অভিভাবক হলে, পরিবারের প্রত্যেক সন্তানকে শিক্ষা দিন, ওদের বন্ধু হতে। ওদের সাথে খারাপ ব্যবহার না করতে। তাদের ব্যাঙ্গ,কটুক্তি বা টিটকারি না করতে। কারণ এতে ওরা দুঃখ পায়। তাদের বোঝাতে হবে, প্রতিবন্ধীরাও তোমারই মতো মানুষ।

*বাড়ি তৈরী করার সময় একবার ভাবুন, আপনার একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী সন্তান থাকলে, আপনি তার জন্য কী ব্যবস্থা নিতেন? কারণ, কোনো দুর্ঘটনা বা অসুস্থ্যতা জনিত কারণে যে কেউ যখন-তখন প্রতিবন্ধী হয়ে যেতে পারেন! তাই বাড়ি তৈরির সময় একটু খেয়াল রাখুন, বাথরুমসহ এর ঘরগুলোর দরজা কী হুইলচেয়ার চলাচলের জন্য যথেষ্ট চওড়া? এ দিকগুলো খেয়াল রেখে ভাড়াটিয়ার জন্যও বাড়ি তৈরি করুন।

*সমস্ত সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে প্রতিবন্ধী মানুষের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ও সুলভে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা। তাদের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক র‌্যাম্প, হুইলচেয়ারসহ অন্যান্য সহকারী সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা। প্রতিবন্ধীদের ব্যবহার উপযোগী বাথরুম বা টয়লেটের ব্যবস্থা করা।

*প্রতিটি স্কুলে র‌্যাম্প রাখুন যাতে একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষ সহজেই তার হুইলচেয়ারটি নিয়ে স্কুলে প্রবেশ করতে পারে।প্রতিবন্ধীদের কর্মক্ষেত্রে যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা চাই। তাই প্রতিটি বাস, ট্রেনসহ অন্যান্য পাবলিক যানবাহনে আসন সংরক্ষণ, শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষ বিশেষ করে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী যাতে সে সব যান-বাহনে সহজেই উঠতে পারেন, সে জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। একইভাবে অন্যান্য প্রতিবন্ধীর জন্যও তাদের উপযোগী ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন।

*বাংলাদেশের কোনো বড় শপিং মল, বিপনী বিতান, এমন কী মার্কেট, সিনেমা হলসহ বিনোদন কেন্দ্রে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য র‌্যাম্পের ব্যবস্থা নেই। তাই সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।

*দেশে রয়েছে নানা ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষ। তাদের জীবন-যাপন সহজ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের সহকারী সরঞ্জাম প্রয়োজন হয়, যেমন সাদা ছড়ি, বিভিন্ন ধরণের হুইল চেয়ার, হিয়ারিং এইড, ভয়েস সিন্থেসাইজার, ব্রেইল পদ্ধতি, ব্রেইল ব্লক--ইত্যাদি প্রয়োজন। সুলভে এগুলোর সহজ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।

*প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য কিছু বাথরুমের সরঞ্জামেরও প্রয়োজন হয়, যা এ দেশে বিরলই বলা যায়। তাদের জন্য পাবলিক টয়লেটগুলোতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

সবশেষে, আমরা বলতে চাই, যে দিকগুলোর কথা তুলে ধরা হলো, এর কোনটিই খুব ব্যয়-বহুল নয়, বরং প্রয়োজন প্রতিবন্ধীদের চাহিদার দিকে নজর দেওয়া।

আপনার প্রতিটি সন্তানই আপনার প্রিয়। আমরা যারা প্রতিবন্ধী, তারাও এ দেশেরই সন্তান। তাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব আমাদের মৌলিক মানবিক দিকটিও নিশ্চিত করা, যাতে আমরা এ দেশের বোঝা হয়ে না থেকে, প্রত্যেকে এ দেশের একজন যোগ্য নাগরিক হতে পারি, দেশের সেবায় নিজেকে কাজে লাগাতে পারি। এই দায়িত্ব শুধু যাদের পরিবারে একজন প্রতিবন্ধী আছে তাদের নয়, আপনারও কারণ বাড়ীর বাইরে যাওয়াই তাদের জন্য খুবই দুঃসাধ্য কাজ।

লেখকঃ সালমা মাহবুব, ২ জানুয়ারী, ২০১০।

0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment

FACEBOOK FACEBOOK AMARBLOG

 
Design by Oronno Anam | Bloggerized by Salma Mahbub