আলোহীন চোখে সাফল্যের ঝিলিক


পৃথিবীর আলো দেখার সৌভাগ্য তাদের হয়নি। মায়ের ভাষার বর্ণমালা বা ইংরেজি অক্ষর কিছুই চোখে দেখেনি তারা। জন্ম থেকেই তারা তিনজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী।। তিনবেলা দুমুঠো ভাতও ঠিকমতো খেতে পায়নি তারা। সাফল্যের পথে আলোহীন চোখ বা দারিদ্র্য কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছেলে তিনটি এবার শিশুদের এসএসসি খ্যাত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছে।

জয়নাল, জাকারিয়া ও মফিদুল সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার পুনটে সমন্বিত অন্ধশিক্ষা সম্প্রসারণ কার্যক্রমের রিসোর্স সেন্টারে থাকে। পাশাপাশি তারা পুনট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের কাছ থেকে পড়া শোনে। আর রিসোর্স সেন্টারে গিয়ে ব্রেইল পদ্ধতিতে একধরনের মুদ্রণপ্রণালী, যা স্পর্শ করেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা পড়তে পারে।

মফিদুলের বাড়ি বগুড়ার গাবতলী উপজেলার তেলীহাটা গ্রামে। শৈশবেই বাবা কলিম উদ্দিনকে হারায় সে। চার ছেলেমেয়েকে মানুষ করার দায়িত্ব এসে পড়ে মা মাজেদা বিবির কাঁধে। মাজেদা বিবি কখনো ভিক্ষা করে, কখনো অন্যের বাড়ি থেকে চেয়েচিন্তে সংসার চালিয়েছেন। কিন্তু ভিক্ষার পয়সায় পাঁচজনের সংসার চলত না। মফিদুলকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের শিশুসদনে রাখার সিদ্ধান্ত নেন মাজেদা। পরে প্রতিবেশী এক শিক্ষকের পরামর্শে শিশুসদনের বদলে জয়পুরহাটের রিসোর্স সেন্টারে ভর্তি করে দেন ছেলেকে।

মাজেদা বিবি বলেন, ‘পরিবারে অন্ধ ছেলে থাকাটা কত কষ্টের, তা যে পরিবারে আছে, সেই পরিবারের মা-বাবাই ভালো বুঝবেন। আর সেটা যদি হয় ভিখারির পরিবার, তাহলে তো কষ্টের শেষ নাই।’

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী জয়নাল আবেদীনের বাড়ি বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার ঘাটমাগুড়া দক্ষিণপাড়া গ্রামে। পাঁচ ছেলেমেয়ে রেখে বাবা আজিজার রহমান মারা গেছেন অনেক আগে। জয়নাল বড় হয়েছে মা জহুরা বিবির কাছে। জহুরা বিবি বিধবা-ভাতার টাকায় ছেলেমেয়েদের লালন-পালন করছেন।

জহুরা বিবি বলেন, ‘গরিব হওয়ার কারণে সুস্থ হওয়া সত্ত্বেও অন্য ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করাতে পারিনি। অথচ অন্ধ স্কুলে ফ্রি থাকা-খাওয়া ও পড়ালেখার খরচ দেওয়ায় জয়নালকে পড়ালেখা করাতে পারছি। ডাক্তার না হোক ওকে মাস্টার বানানোর ইচ্ছা আছে আমার।’ ফলাফলে উচ্ছ্বসিত জয়নাল বলে, ‘চোখের আলোয় যদি দেখতে পারতাম! তাহলে এই খুশি আর সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারতাম।’

দৃষ্টিহীন অপর মেধাবী জাকারিয়া শেখের বাড়ি বগুড়ার শেরপুর উপজেলার জয়লাজুয়ান গ্রামে। তারা চার ভাই। বাবা শেখ মো. আবু বক্কর সিদ্দিক ভূমিহীন দিনমজুর। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। আবু বক্কর বলেন, ‘জাকারিয়া ভালো ফল করেছে, এতে খুব খুশি হয়েছি। আরও খুশি হব যদি সে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে।’

রিসোর্স সেন্টারের শিক্ষক জেল হোসেন বলেন, প্রতিবন্ধী হলেও তারা অদম্য, জীবনে একটা কিছু হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে তারা এগিয়ে চলেছে। তারা শুধু পড়ালেখায় নয়, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, খেলাধুলাতেও পারদর্শী। মফিদুল আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসে কোরআন তেলাওয়াত করে জেলা পর্যায়ে প্রথম পুরস্কার লাভ করেছে।
পুনট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোখলেছার রহমান বলেন, দৃষ্টি নেই, অর্থ নেই, পড়ালেখা করার মতো সামর্থ্যও নেই তাদের। কিন্তু সব বাধা পেরিয়ে ওই তিন অদম্য মেধাবী প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছে। কালাই উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আব্দুল হান্নান, দৃষ্টিহীন হয়েও তারা অসাধ্যকে সাধন করেছে। তাদের এ প্রশংসনীয় ফলাফল অন্যদেরও প্রেরণা জোগাবে।

তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো
http://prothom-alo.com/detail/date/2010-01-03/news/32285



0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment

FACEBOOK FACEBOOK AMARBLOG

 
Design by Oronno Anam | Bloggerized by Salma Mahbub