উন্নয়ন ব্যয়ের আধা শতাংশও পান না দেড় কোটি প্রতিবন্ধী

প্রতিবন্ধীরা সমাজে অচ্ছুৎ বলে চিহ্নিত হয়ে আসছেন। প্রতিবন্ধীদের দেখলে সবার মধ্যে একটু এড়িয়ে চলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এসব অসহায় মানুষের যে সহানুভূতি পাওয়ার অধিকার রয়েছে সে খোঁজ কেউ রাখেন না। এসব মানুষকে পরিবার যেমন দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে, তেমনি রাষ্ট্রযন্ত্রও। দেশের দেড় কোটি প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য বাজেটে বরাদ্দ চাহিদার আধা শতাংশও নয়। নৈতিক, মানবিক, ন্যায়বোধ ও সৌন্দর্যবোধ_ কোনো দিক থেকেই এ অবস্থা কাম্য হতে পারে না। রাষ্ট্র যদি প্রতিবন্ধীদের প্রতি তার দায়-দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তাহলে প্রতিবন্ধিতা বাড়বে। এর ফলে দারিদ্র্যও বাড়বে।


অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. আবুল বারকাত সম্প্রতি প্রতিবন্ধী ও দারিদ্র্য চক্র নিয়ে গবেষণা করেছেন। গবেষণায় তিনি এ চিত্রটি তুলে ধরেছেন। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের হতে উন্নয়ন বাজেটের ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে ব্যয় করার সুপারিশ করেছেন তিনি।


১৫ কোটি মানুষের বাংলাদেশে দেড় কোটি লোকই কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী। প্রতি দুই খানার মধ্যে একটি খানায় প্রতিবন্ধী রয়েছেন। এই দেড় কোটি প্রতিবন্ধী মোটামুটি পাঁচ ধরনের প্রতিবন্ধিতার শিকার। এর মধ্যে ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ (৭৯ লাখ) শারীরিক প্রতিবন্ধী, ১৫ দশমিক ১ শতাংশ (সাড়ে ২২ লাখ) দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ (২২ লাখ) বাক্-শ্রবণ প্রতিবন্ধী, ১৪ শতাংশ (১৬ লাখ) বুদ্ধি প্রতিবন্ধী এবং ৬ দশমিক ৭ শতাংশ (১০ লাখ) বহুমুখী প্রতিবন্ধী। ড. আবুল বারকাতের হিসাবমতে, মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তীতে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫ কোটি ২০ লাখ। অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে আগামী ১১ বছরে মোট প্রতিবন্ধীর সংখ্যা বর্তমানের তুলনায় প্রায় তিনগুণ হবে। দারিদ্র্যের চক্রে আটকে গেছে দেশের প্রতিবন্ধীদের জীবন। প্রতিবন্ধিতা আর্থ-সামাজিক নিরপেক্ষ বিষয় নয়। ধনীদের তুলনায় দরিদ্ররা অধিক হারে প্রতিবন্ধিতার শিকার। দারিদ্র্য নিজেই প্রতিবন্ধিতা সৃষ্টির অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। রাষ্ট্র যদি প্রতিবন্ধীদের দায়িত্ব নিতে ব্যর্থ হয় তখন নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ওপর প্রতিবন্ধিতার 'বোঝা' আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়বে। উত্তরোত্তর পরিবারটির আর্থিক বুনিয়াদ দুর্বল হবে।


ড. আবুল বারকাত তার গবেষণায় বিশ্লেষণ করেছেন, দেশের প্রায় ৯৯ লাখ প্রতিবন্ধী মানুষ অতিদরিদ্র পরিবারের সদস্য। অন্যদিকে প্রায় ৪ লাখ প্রতিবন্ধী রয়েছেন ধনী পরিবারের সদস্য হিসেবে।


আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রায় ৪৭ লাখ প্রতিবন্ধী মধ্যবিত্ত পরিবারে রয়েছেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে ২৫ লাখ নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। দ্রবমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মধ্যবিত্তের জীবনযাপনই যেখানে কষ্টকর, সেখানে পরিবারের প্রতিবন্ধী সদস্যের জন্য বাড়তি কিছু করার সাধ থাকলেও সাধ্যে কুলায় না।
প্রতিবন্ধীদের নিয়ে প্রতিটি সরকারই উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। ২০০৭-০৮ সালের উন্নয়ন বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সে বছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ১ হাজার ৩২টি প্রকল্প নেওয়া হলেও প্রতিবন্ধীদের জন্য পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে মাত্র ৫টি প্রকল্প নেওয়া হয়। অথচ দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধী।


উন্নয়ন ব্যয়ের আধা শতাংশও ব্যয় হয় না প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরের এডিপির সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে মাত্র ১৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা রাখা হয়েছে প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে।
ড. আবুল বারকাত তার গবেষণায় বলেছেন, দেড় কোটি প্রতিবন্ধীর কল্যাণে সরকারের বার্ষিক বরাদ্দ থাকা উচিত ১৩ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা। এ হিসাবের মধ্যে সহায়ক উপকরণ বাবদ ২ হাজার ৯৬৩ কোটি, চিকিৎসা ব্যয় ১ হাজার ৩৬৮ কোটি, কর্মসংস্থান ব্যয় ২ হাজার ৫০০ কোটি, খাদ্য অনুদান ৪ হাজার ৫৬২ কোটি এবং প্রতিবন্ধিতা রোধ সহায়ক ব্যয় ২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। কিন্তু সরকারের কাছে এটা অবাস্তব হতে পারে। তাই মোট উন্নয়ন ব্যয়ের ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে ব্যয় করার সুপারিশ করেছেন ড. আবুল বারকাত।
-জাহাঙ্গীর শাহ কাজল




সুত্রঃ ১৮ এপ্রিল, ২০১০, সমকাল।

0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment

 
Design by Oronno Anam | Bloggerized by Salma Mahbub