স্বপ্ন ছুঁতে ওদের পথচলা

ওদের স্বপ্নের জানালার পরিধি কতটুকুই বা বিস্তৃত? তবে আর দশটা শিশুর মতো ওদেরও স্বপ্ন আছে। ওরা তো স্বপ্ন দেখতেই পারে। কিন্তু ওদের স্বপ্নের জানালার ফুটো দিয়ে আর কতটুকু আলোই বা পৌঁছায়? কতটুকু আলো ওদের স্পর্শ করতে পারে?
তবে ভালো লাগল এই ভেবে—যেটুকু আলো ওদের কাছে পৌঁছাতে পারে, সেই আলোর সহযাত্রী হয়ে নিরন্তর প্রচেষ্টায় শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে মাড়িয়ে ছোট্ট দুটি শিশু অমিত আর তান্নি এগিয়ে যাচ্ছে।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভুনবীর ইউনিয়নের রাজপাড়া গ্রামের মো. লেবু মিয়ার ছেলে অমিত মিয়া। সে এবার পাত্রীকূল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। আর দশটা শিশুর মতো সে হাঁটতে পারে না। গ্রামে ধাত্রীর হাতে জন্মের সময় অমিতের ডান পা ভেঙে যায়। আর জোড়া লাগেনি।
অমিতের মনে কষ্টের পাহাড়। সে সহপাঠীদের সঙ্গে একসঙ্গে হেঁটে বিদ্যালয়ে যেতে পারে না। দৌড়াতে পারে না। খেলতে পারে না। তার অন্য সব সহপাঠী, গ্রামের প্রতিবেশী শিশুরা যখন মাঠে খেলা করে, সে তখন চেয়ে চেয়ে দেখে। তার চোখের কোণে তখন বিন্দু বিন্দু নোনাপানি এসে জমা হয়। কয়েক ফোঁটা গড়িয়েও পড়ে মাটিতে। অমিতের খু-উ-ব রাগ হয়। রাগে সে নিজের মাথার চুল ধরে টানে। এক সময় আর পারে না।
বুকভরা দম নিয়ে দুই হাতের ওপর ভর দিয়ে নেমে পড়ে মাঠে। অন্যদের পেছনে পেছনে বল ধরার জন্য ছুটে যায়। শুধুই ছুটে যায়। কদাচিত্ বল হাতের কাছে পায়। তবু সে দমে না। অমিত সম্পর্কে এসব কথা তারই সহপাঠী, প্রতিবেশী শিশুদের কাছে শোনা।
অমিতের বাবা মো. লেবু মিয়া জানান, অমিত পাত্রীকূল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। ২০০৭ সালে অমিতকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর ঢাকা থেকে কয়েকজন এসেছিলেন। অমিতের জন্য এক দম্পতি স্থানীয় এক সাংবাদিকের মাধ্যমে হুইলচেয়ার পাঠিয়েছিলেন। চেয়ারটা এখন ভেঙে গেছে। তখন আরও কয়েকজন এসেছিলেন। তাঁরা ক্র্যাচ, বই-খাতা, শার্ট-প্যান্ট দিয়েছিলেন। অমিত তখন তৃতীয়
শ্রেণীতে পড়ত।
সম্প্রতি বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে অমিতের সঙ্গে রাস্তায় দেখা। দুই হাতের ওপর ভর দিয়ে হাঁটুতে ঠেক দিয়ে অমিত সহপাঠীদের সঙ্গে যাচ্ছে। পড়ালেখা কেমন চলছে প্রশ্নের জবাবে ভিতু স্বভাবের অমিত নিরুত্তর থাকে। তার তীক্ষ� দৃষ্টি আমার চোখের দিকে। স্থির তার চোখের পাতা। পড়ালেখা শিখে কী হবে? এ প্রশ্নের উত্তরে অমিতের জবাব, ‘মাস্টর অইমু’ (শিক্ষক হব)। ২০০৭ সালে অমিতের সঙ্গে প্রথম দেখায় ওই প্রশ্নের সে একই উত্তর দিয়েছিল। দেখলাম তার চোখে স্বপ্নের দ্যুতিময়তা। আর মনে আছে প্রতিজ্ঞা পূরণের প্রত্যয়।
মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালাপুর ইউনিয়নের কালাপুর গ্রামের আরেক শিশু তান্নি। সেও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তুচ্ছ মনে করে স্বপ্নকে ছুঁতে পথ চলছে। জন্মের পর থেকেই অসুস্থতা তান্নির স্বাভাবিক চলার শক্তি কেড়ে নিয়েছে। তার ডান হাতটি সম্পূর্ণ অবশ। ডান পা ও বাঁ হাতও আংশিক অচল। তবু শারীরিক এই প্রতিবন্ধকতা তাকে দমাতে পারেনি। একটি সচল পা আর একটি অর্ধসচল হাত নিয়েই স্বপ্ন ছোঁয়ার যুদ্ধে নেমেছে সে। রং-তুলি নিয়ে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলছে তার প্রতিভা। বিভিন্ন চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অন্যসব স্বাভাবিক শিশুর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। পুরস্কার ছিনিয়ে আনছে।
তান্নি চিকিৎসক হতে চায়। পড়ালেখা করে কী হবে প্রশ্নের উত্তরে তার ছোট্ট জবাব, ‘ডাক্তর অইমু’ (চিকিৎসক হব)।
তান্নির দিনমজুর বাবা মো. আলা মিয়া জানান, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির কালাপুর প্রি-প্রাইমারি স্কুলে তাকে ভর্তি করিয়েছেন। ওই স্কুল থেকে পরে কাছাকাছি একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেবেন। আলা মিয়ার দুঃখ, আর দশটা শিশুর মতো তান্নি চলতে পারবে না। এই দুশ্চিন্তা তাঁকে প্রতিনিয়ত তাড়া করছে।
তান্নির মা সাফিয়া আক্তার জানান, জন্মের পরপরই তান্নি হাত-পা নাড়াতে পারেনি। স্থানীয় চিকিৎসক ও বিভিন্ন হাসপাতালে মেয়েকে নিয়ে গেছেন। চিকিৎসকেরা আশ্বাস দিয়েছিলেন যে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু হয়নি। আর্থিক সংগতি না থাকায় ভালো চিকিৎসা করানো কখনোই সম্ভব হয়নি। তান্নি এখন বাঁ হাত দিয়ে কোনোমতে লেখাপড়া করতে পারে। বাঁ পায়ের সহায়তায় অর্ধসচল বাঁ হাত দিয়ে ছবি আঁকে।
অমিত, তান্নিরা বোঝে না ওদের স্বপ্নের পরিধি কতটা বিশাল। জানে না বাস্তবতার সীমাবদ্ধতায় ওদের স্বপ্নের প্রজাপতি কতটা ডানা মেলতে পারবে। কতটা উঁচুতে উড়তে পারবে। তবু ওরা স্বপ্ন দেখবে। স্বপ্ন দেখাবে। ওদের বিশাল সব স্বপ্নের পাশে চাই মানবিক মূল্যবোধের ছোঁয়া। চাই সহযোগিতা, সহমর্মিতা আর ভালোবাসার স্পর্শ।


সুত্রঃ  ৭ মে ২০১০, শুক্রবার, প্রথম আলো।

0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment

 
Design by Oronno Anam | Bloggerized by Salma Mahbub