আলো অন্ধকারে যাই

দৌড়ে গিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর বাসটিকে ধরতে পেরে আমরা প্রফুল্লমনে বাড়ি ফিরি। কিন্তু জীবনে প্রতিটি পদক্ষেপে যিনি অন্যের সাহায্য ছাড়া হাঁটতেই পারেন না, তাঁর বেলায়? হ্যাঁ, এমনই একজন স্বপ্নসারথির সঙ্গে আমাদের পরিচয় হবে আজ, যাঁর পুরো জীবনটাই প্রতিবন্ধকতাময়।


১৯৯৩ সালের ৫ নভেম্বর গাজীপুর সদর থানার খুনদিয়া গ্রামে রমিজ উদ্দিন ও হনুফা খাতুনের ঘরে জন্ম নেন এই দৃষ্টিহীন বন্ধু। নাম তাঁর আলী হুসাইন। পৃথিবীর আলো না দেখেও যিনি পৃথিবীর বুকে ইতিহাস রচনার স্বপ্ন দেখেন হৃদয়ে। যাঁর জন্ম স্বাভাবিক ছিল না বলে আত্মীয়স্বজন কেউই খুশি হতে পারেননি। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই আলী বড় হতে থাকেন এবং এখন তিনি অনেক বড়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে আলী হুসাইন নিজের যোগ্যতার বড় প্রমাণ দিতে পেরেছেন। আলী হুসাইন বাংলাদেশের ইতিহাসে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম এবং এখন পর্যন্ত জিপিএ-৫ পাওয়া একমাত্র দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী।


জন্মের পর থেকেই ভীষণ প্রতিবন্ধকতা আর রুক্ষ জীবনগতি তাঁকে কিছুতেই রুখতে পারেনি। বড় হতে হতে তিনি অনুভব করতে থাকেন, তিনি চরম নিঃসঙ্গ। বন্ধুরা খেলছে, হইহল্লা করছে, স্কুলে যাচ্ছে, তিনি কিছুই করতে পারছেন না। প্রথম দিকে তাঁর মা-বাবা জানতেনই না যে অন্ধদের শিক্ষার সুযোগ আছে এবং যখন জানলেন, তখন দেখলেন, দরিদ্র পরিবারের জন্য তাঁর ব্যয় বহন অসম্ভব।


কপাল খুলল অন্যভাবে। বিভিন্ন মাধ্যমে তাঁরা খবর পেলেন, গাজীপুরেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। আলীর পাঠ শুরু হলো সেখান থেকেই থেকেই।


জানুয়ারি ২০০৩ সাল। আলী হুসাইন বিভিন্নজনের সাহায্য নিয়ে ভর্তি হন সমন্বিত অন্ধশিক্ষা কার্যক্রম নিলের পাড়া উচ্চবিদ্যালয় জয়দেবপুর গাজীপুরে।


লুইস ব্রেইল আবিষ্কৃত ‘ব্রেইল’পদ্ধতিতে শুরু হয় পড়াশোনা। মাত্র ১৫ দিনে এ পদ্ধতি আয়ত্ত করেন তিনি। শেষ করেন স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ শিক্ষা। ২০০৩ সালের মার্চে ভর্তি হন দ্বিতীয় শ্রেণীতে। সেই শ্রেণীতে থাকতেই তাঁর চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত সব বই পড়া হয়ে যায়। দ্রুতগতিতে এগোতে থাকেন আলী। এভাবে ২০০৬ সালে এসে তিনি সরাসরি ভর্তি হয়ে যান নবম শ্রেণীতে। সব চাপ কাটিয়ে ব্রেইল-পদ্ধতিতে ছাপানো সরকারি বই পড়ে এবং অষ্টম শ্রেণীর একজন শ্রুতিলেখক দিয়ে তিনি পরীক্ষা দেন। জিপিএ ৩.৯৪ পেয়ে পাস করেন। এবার বিপত্তি বাধে সামনে এগোনো নিয়ে। কেননা, এবার আর সরকারি বই নেই। আর এ পদ্ধতিতে বই ছাপানোর টাকার পরিমাণ বেশি। সাত ভাইবোনের আলীর পরিবারে তাই বাবাও অসহায়।


আলীও দমার পাত্র নন। বাবার আশা ছেড়ে দিয়ে শুরু করেন অন্যভাবে। বন্ধুদের সাহায্যে ক্যাসেট প্লেয়ারে বই রেকর্ড করে আলী উচ্চমাধ্যমিকের বই মুখস্থ করতে থাকেন এবং আলী শেষে বোর্ডের অনুমতি নিয়ে দশম শ্রেণীর ছাত্রের দিয়ে শ্রুতিলিখন করে উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পান। মাধ্যমিক বিভাগের ছাত্র আলী ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ১৭২১তম স্থান অধিকার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান।


এখনকার গল্পও সহজ নয়। আলী হুসাইনদের গল্প প্রতিনিয়ত কঠিন। প্রতিক্ষণে অনিশ্চয়তা তাঁদের ঘিরে ধরে। আঁধার ফুটে ওঠে বারবার আলীদের চোখে। এটাই যে স্থায়ী সত্য। আলী কী করবেন এবার? এবার টাকা দিয়ে আলীর জন্য বড় বড় বই, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ বা ব্রেইল-পদ্ধতিতে বই ছাপিয়ে দেবে কে? কে দেবে আলীর ক্যাসেট প্লেয়ার আর খাওয়া খরচ? কে বহন করবে আলীর জীবনের বাড়তি ব্যয়? আলী কি কষ্ট আর লাঞ্ছনা পেতেই থাকবেন? আলী বলেন, ‘আমি আত্মবিশ্বাসী। সবাই আজ পর্যন্ত যেভাবে আমাকে সাহায্য করে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে, সামনের দিনগুলোতে তাঁরা আমার পাশে থাকবেন।’


আলী সংস্কৃতিমনা মানুষ। দারুণ গান ধরতে জানেন। তাঁকে ছেড়ে আশার সময় শোনাচ্ছিলেন—‘আমি অন্ধ হতে পারি, হূদয় আমার অন্ধ নয়/ মনেরই চোখ দিয়ে দেখব তোমায়/ থাকব তোমার ভালোবাসাতে’।


সুত্রঃ মাহমুদ ফাহাদ, তারিখ: ০৮-১২-২০১০, প্রথম আলো।

0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment

 
Design by Oronno Anam | Bloggerized by Salma Mahbub