দেশে সাড়ে পাঁচ লাখ শিশু রিকেটে আক্রান্ত

দেশে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে সাড়ে পাঁচ লাখ রিকেট রোগে আক্রান্ত। রিকেট বিষয়ে প্রথম জাতীয় জরিপে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রিকেট বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে।

গতকাল মঙ্গলবার ব্র্যাক সেন্টারে আনুষ্ঠানিকভাবে এ জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করেন রিকেটস ইন্টারেস্ট গ্রুপের আহ্বায়ক এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র-বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী এস কে রায়। তিনি জানান, দেশের ছয়টি বিভাগের ২০ হাজার শিশুর ওপর ১০ মাস সময় নিয়ে এই জরিপ করা হয়। জরিপে দেখা গেছে, ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের দশমিক ৯৯ শতাংশ শিশু রিকেটে আক্রান্ত। এদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ। এই শিশুদের ৯৮ শতাংশ ভিটামিন ডি এবং ৪৯ শতাংশ ক্যালসিয়াম ঘাটতিতে ভুগছে। জরিপ অনুযায়ী, ছয়টি বিভাগের মধ্যে চট্টগ্রামে রিকেট আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। রিকেট আক্রান্তদের ৭৬ শতাংশই এই বিভাগে।
রিকেটস ইন্টারেস্ট গ্রুপের তত্ত্বাবধানে (আইসিডিডিআরবি), জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ), কেয়ার বাংলাদেশ, জাতীয় পুষ্টি প্রকল্প, সোশ্যাল অ্যাসিসট্যান্স অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ফর দ্য ফিজিক্যালি ভালনারেবল (এসএআরপিভি), প্ল্যান বাংলাদেশ এবং ব্র্যাক এ জরিপ করে।
অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিশুর দেহে ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়ামের অভাবে রিকেট হয়। এতে শিশুর ওজন কমে, শুকিয়ে যায়, শিশু বয়সের তুলনায় খাটো হয়। অনেক ক্ষেত্রে কবজি ফুলে যায়, কারও পা বেঁকে যায়। কারও বুকের খাঁচার হাড়ে গোটা বের হয় বা কপালের হাড় সামনের দিকে বের হয়ে যায়।

প্রতিকার হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিশুকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ এবং ছয় মাসের পর যথাযথ পরিপূরক খাবার খাওয়ানো, শিশুর শরীরে পর্যাপ্ত রোদ লাগানো হলে এ রোগটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। সরকারি পর্যায়ে চিকিত্সার ব্যবস্থা না থাকায় রিকেট আক্রান্ত শিশুদের প্রতিবন্ধী হয়ে জীবন কাটাতে হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক শাহ মনির হোসেন বলেন, জাতীয় পুষ্টি প্রকল্প সঠিকভাবে চললে ও রিকেটকে গুরুত্ব দিলে এই রোগটি হওয়ারই কথা ছিল না। ইউনিসেফের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিভাগের প্রধান বির্থে লোকাটিলি রছি রিকেট প্রতিরোধে অব্যাহতভাবে সহায়তার আশ্বাস দেন। অনুষ্ঠানে ফ্রান্সের রিকেট সার্জারি চিকিত্সক ক্রেভেরি থাইরি বলেন, রিকেট অস্ত্রোপচার করে ভালো করা সম্ভব। তবে এটি অত্যন্ত জটিল, ব্যয়বহুল ও শিশুদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক।

তথ্যসুত্রঃ প্রথম আলো
http://prothom-alo.com/detail/date/2010-01-27/news/37996

১০ মিনিটে মুখ


ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় বসে বসে মানুষের মুখ আঁকেন পার্থ রায়। বাক্প্রতিবন্ধী এই মানুষটি অন্যের মুখচ্ছবি এঁকেই জীবন চালান। এস এম সুলতানের সাক্ষাত্ ছাত্র ছিলেন তিনি। তাঁর নড়াইলের আর্ট স্কুল ‘শিশু স্বর্গে’ বসেই ছবি আঁকা শিখেছেন পার্থ।
চারকোলের পেনসিল দিয়ে সাদা কাগজের মধ্যে ঘষাঘষ রেখা টেনে চলেন একমনে। দেখতে দেখতেই এক সময় বের হয়ে আসে সামনে বসা মানুষটার মুখ। লোকজন সবকিছু ফেলে ভিড় করে দেখে তাঁর এই কাজকর্ম। কাজ শেষে নগদ প্রাপ্তি হয় ভালোই। সেই সঙ্গে বেশ বাহবাও মেলে।
পার্থ রায় লিখে জানালেন, প্রতিটি সাদাকালো ছবির জন্য ২০০ টাকা রাখেন তিনি। আর রঙিন হলে ৪০০ টাকা। মেলায় বসলে সারা দিনে আট-দশজন পাওয়া যায়। বাণিজ্য মেলা শেষ হয়ে গেলে বইমেলা শুরু হবে, তখন তাঁকে দেখা যাবে ওখানেই। আর প্রত্যেক ঈদে তাঁকে পাওয়া যাবে শিশু পার্কের চৌহদ্দীতে।

রথ দেখা, সেই সঙ্গে কলা বেচা
ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা নিয়ে কিছুটা বাড়তি উত্সাহ কাজ করে অনেকের মধ্যেই। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই আসেন মেলা দেখতে। ‘দূরত্ব যতই হোক, কাছে থাকুন’ এমন চিন্তা থেকে নরসিংদী থেকে মেলা দেখতে এসেছে দুটি পরিবার। পরিবার-পরিজন নিয়ে সারা দিন ঘোরাফেরা-কেনাকাটা আর হই-হুল্লোড় শেষে মেলা প্রাঙ্গণেই চাদর পেতে বসে পড়লেন তাঁরা। আর সঙ্গে করে আনা ব্যাগ থেকে বের হতে থাকে হরেক রকম খাবার। মেলায় আসা অন্য দর্শনার্থীরা খানিকটা কৌতূহলী হয়ে দেখতে থাকে ব্যাপারটা। লোকজনের এই কৌতূহল দেখে এক পরিবারের কর্তা খানিকটা আয়েশি ভঙ্গিতে বলেই ফেললেন, ‘ভাই, রথ দেখা আর কলা বেচা একই সঙ্গে সেরে ফেললাম।’

তথযসূত্রঃ প্রথম আলো, ১ জানুয়ারী, ২০১০।
http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-01-24/news/37174

বদলে যাওয়ার অভিযাত্রায় প্রতিবন্ধী স্কাউটরাও প্রত্যয়ী


‘আমরা যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলি না। আমরা চাই অন্যরাও যেন যেখানে-সেখানে ময়লা না ফেলে। আর এভাবেই আমরা সবাই বদলে যাব।’ অষ্টম জাতীয় স্কাউট জাম্বুরিতে অংশ নেওয়া বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কাউট শিউলি আক্তার গোছানো বাক্যে কথাগুলো বলছিল।
লক্ষ্মণাবন্দ ভিলেজে অন্য স্কাউটদের সঙ্গে নিয়মিত কার্যক্রমে অংশ নেওয়া রাজশাহীর পঙ্গু শিশু নিকেতনের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মো. রুবেল বলে, ‘আমি চোখে দেখি না, তবু আমি থেমে যাব না। পড়াশোনা করে মর্যাদা নিয়ে এগিয়ে যাব। স্কাউটিং থেকে সেই আত্মমর্যাদার দীক্ষা পেয়েছি। যা সবার জীবনে দরকার।’ কনকনে শীতের মধ্যেও হাসি ছিল তার মুখে। সে বন্ধুত্ব করতে এসেছে। তার অনেক বন্ধু দরকার।
গতকাল মঙ্গলবার ছিল অষ্টম জাতীয় স্কাউট জাম্বুরির ষষ্ঠ দিন। গজারি বন সারা দিনই ছিল কুয়াশাচ্ছন্ন। এতে বিন্দুমাত্র কমে যায়নি স্কাউটদের উদ্যম। নিয়মিত কার্যসূচিতে বনে অভিযাত্রা স্কাউটদের উত্সাহে যোগ করে নতুন মাত্রা।
অভিযাত্রা, সমাজ চেতনা, আমার লক্ষ্য, তাঁবু সজ্জার মতো প্রায় সব চ্যালেঞ্জেই অংশ নিচ্ছে প্রতিবন্ধী স্কাউটরা। তাদের উদ্যম আর আনন্দের সামনে সব বাধাই যেন তুচ্ছ। জাম্বুরিতে তারাও বদলে দেওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে এসেছে। তবে এ ব্যাপারে সমাজের সবার সহযোগিতা চেয়েছে তারা। এবারের জাম্বুরিতে ১৩০ জন প্রতিবন্ধী স্কাউট অংশ নিচ্ছে।
সুইড বাংলাদেশের স্কাউট বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী প্রজ্ঞা পারমিতার শখ নৃত্য করা। নতুন কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব হলেই সে নেচে তাদের আনন্দ দিচ্ছিল। প্রজ্ঞা জানাল, এখানে আসার পর তার অনেক বন্ধু হয়েছে। সে সারা জীবন এসব বন্ধুকে কাছে পেতে চায়। একই প্রতিষ্ঠানের স্কাউট রাশিদা খাতুনও জানিয়েছে তার শখ নাচ করা। এখানে এসে তার কেবল নাচতেই ইচ্ছে করছে। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মোহসেনা আক্তার জানাল, এখানে এসে সে অনেক কাজ করতে শিখেছে। দেশের মঙ্গলের জন্য সে এখন থেকে কাজ করবে।
লক্ষ্মণাবন্দ ভিলেজে নিয়মিত কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছিল ওই ভিলেজের স্কাউটরা। মাঠে সারি বেঁধে বসেছিল তারা। এর মধ্যে ছিল রাজশাহীর পঙ্গু শিশু নিকেতনের সোহেল রানা। পোলিওর কারণে তার একটি পা ও একটি হাত অকেজো। তবু তার উদ্যম থেমে নেই। বার বার হাত উঁচিয়ে কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছিল। সোহেল রানা বলে, ‘আমি অনেক দূর যেতে চাই। অনেক বড় পৃথিবী দেখতে চাই। স্কাউটিং আমাকে সে পৃথিবী দেখাবে। আমি চাই, যারা সুস্থ স্বাভাবিক আছে, তারা যেন আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে।’ সড়ক দুর্ঘটনায় আট বছর আগে শিশু বয়সে শারীরিক প্রতিবন্ধী হয় হায়দার আলী। এখন সে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে। সে আত্মমর্যাদায় বলীয়ান হতে প্রত্যয়ী। এ ব্যাপারে সমাজের সবার সহযোগিতা চায় সে।
সুইড বাংলাদেশের স্কাউট বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিউলি আক্তার, রায়হান কবীর, নাজমুল ইসলাম, শাহীন, সারমিন লিপিরা এখানেই থেমে যেতে চায় না। ওরা স্পেশাল অলিম্পিকে অংশ নিয়ে দেশের জন্য সম্মান নিয়ে এসেছে। সারমিন ১০০ মিটার দৌড়ে স্বর্ণপদক জিতেছে চীনে। আর শাহীন বিজয়ী ফুটবল দলে খেলেছে। ওরা চায় দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ। কথার ফাঁকেই তারা জানাল, সরকার চাকরির আশ্বাস দিলেও তারা চাকরি পাচ্ছে না। সারমিন লিপি প্রথম আলোকে বলে, আমরা কাজ করতে পারব, আমরা চাই সরকার আমাদের চাকরির ব্যবস্থা করুক। আর এ ব্যাপারে সমাজের সব মানুষকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
সুইড বাংলাদেশের শিক্ষক হাসিনা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমে আশঙ্কা ছিল ওরা পারবে না। আর এখন ওরা বাড়ি যেতে চাইছে না। ওদের সামাজিক করে তোলার জন্য এ ধরনের অনুষ্ঠান বেশ কার্যকর।
সকালে ‘সমাজ চেতনা’ কার্যক্রমে জাম্বুরি এলাকার দক্ষিণ মৌচাক, লোহাকৈর ও কামরাঙ্গাচালা এলাকায় স্কাউটরা মাটির রাস্তা সম্মিলিতভাবে মেরামত ও দুটি বাঁশের সাঁকো তৈরি করে। স্কাউটরা ওই এলাকার দরিদ্র পরিবারের বাড়ির আঙিনায় সবজি বাগান করে দেয়, গর্ভবতী মায়েদের চিকিত্সা পরামর্শ, বাড়ির গবাদি পশুর যত্ন ও চিকিত্সার নিয়ম, ওরস্যালাইন তৈরি করাসহ নানা বিষয়ে ধারণা দেয়।
সন্ধ্যায় জাম্বুরির ১৫টি সাব ক্যাম্পফায়ারে প্রধান অতিথি ছিলেন বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব মিহির কান্তি মজুমদার, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন, জাতীয় ফাউন্ডেশনের ম্যানেজমেন্টের সভাপতি ফয়জুর রহমান চৌধুরী, বাংলাদেশ স্কাউটসের কোষাধ্যক্ষ আব্দুল কাইয়ুম ঠাকুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক প্রমুখ।

তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো
http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-01-25/news/36318

বেঁচে থাকাটাও যখন অমানবিক

আমার গ্রামের হতদরিদ্র আবদুল আলীম অনেক কষ্টে আমার বাসাটা খুঁজে যে ঘটনাটা জানালো, আমি লা জওয়াব ছিলাম অনেকক্ষন। তার তেরো বছরের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সন্তানকে নিয়ে কোথাও থেকে আসার পথে বাসের চাপায় তার স্ত্রীর তাৎক্ষনিক মৃত্যু হয় এবং ছেলেটা মারাত্মক আহত হয়। উরু থেকে নীচের অংশের হাড় গুড়িয়ে যায়।

মেডিক্যালে সপ্তাহ দুয়েক থাকার পর ওরা রিলিজ করে দেয়, গ্রামে গিয়ে দেখে ভেতরের হাড় মোটেও জোড়া লাগেনি। হাজার হাজার টাকা দিয়েও জোড়া লাগানো সম্ভব না আর। তার পক্ষে এক হাজার টাকা খরচ করাও সম্ভব না। ছেলেটা মুখে কথা বলতে পারে না, কেবল গোঁ গোঁ চিৎকার করে আর যাকে সামনে পায় আচড়ে খামচে রক্তাক্ত করে দেয়। এখন সে ব্যাথায় কাতরাচ্ছে, শীতে কোঁকাচ্ছে, বিছানায় পেশাব পায়খানা করে একাকার। তাকে দেখার মতো কেউ নেই। ভীষন দুরাবস্থা।

আবদুল আলীম নিজের আয়ে নিজে চলতে পারে না, আহত ছেলেটাকে কি করে সামলাবে? সে নিজেই যেখানে সামলাতে পারছে না, অন্য কেউ সহ্য করবে কেন। সুতরাং আবদুল আলীম আমার কাছে এসেছে ছেলেটাকে কোথাও দুর করা যায় কিনা সে ব্যবস্থা করতে। কোথাও কোন সংস্থা আছে কিনা সেরকম। সে বারবার আক্ষেপ করছিল দুর্ঘটনায় ছেলেটা যদি মারা যেত তাহলে তার এই কষ্টে পড়তে হতো না। সে আকুল হয়ে ছেলেটার মৃত্যু কামনা করছে যেন। কতটা অসহায় অবস্থায় পড়লে মানুষ এই কথা বলতে পারে।

আমি কোন সমাধান দিতে পারিনি। বলেছি খোঁজ নিয়ে জানাবো। এখনো পাইনি সেরকম কোন খোঁজ। কারন সেরকম কোন সংস্থার খবর আমার জানা নেই যারা এরকম মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধিদের আশ্রয় লালন পালন করে। কারো কি জানা আছে? জানা থাকলে একটা মেইল দিয়ে জানাবেন প্লীজ uniresources@gmail.com

কখনো কখনো বেঁচে থাকাটাও একটা অমানবিক, অবিচার!


লেখকঃ নীড় সন্ধানী, ২৩ জানুয়ারী, ২০১০।

http://hrrh69.amarblog.com/posts/97014

অবশেষে হচ্ছে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা নীতিমালা

প্রতিবন্ধী শিশুদের সাধারণ স্কুলে ভর্তির সরকারি নীতিমালা হচ্ছে। তিন বছর ধরে প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নানা উদ্যোগ চলছে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ছাড়াই। নীতিমালা না থাকায় প্রতিবন্ধী শিশুদের সাধারণ স্কুলে ভর্তির কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। উপরন্তু প্রতিবন্ধীদের ভর্তি করতে গিয়ে স্কুলগুলোও পড়ছে নানা বিভ্রান্তিতে। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত প্রতিবন্ধী দিবসের অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেছেন, প্রতিবন্ধীদের সাধারণ স্কুলে ভর্তি করতে অনিচ্ছুক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রতিবন্ধী শিশুদের সাধারণ স্কুলে লেখাপড়ার বিষয়ে এত দিনেও সরকারি নীতিমালা তৈরি হয়নি। তবে শিগগিরই এ নীতিমালা তৈরি করা হবে। তিনি জানান, নীতিমালা তৈরি করতে আজ শুক্রবার থেকে সারা দেশে শিশু ও সাক্ষরতা বিষয়ে পাঁচ দিনব্যাপী জরিপ পরিচালিত হবে। এ জরিপে প্রতিবন্ধী শিশুদের সংখ্যা এবং কে কোন ধরনের প্রতিবন্ধী তা চিহ্নিত করা হবে। জরিপে চিহ্নিত প্রতিবন্ধীদের মধ্যে যারা সাধারণ স্কুলে পড়তে সক্ষম, তাদের সাধারণ স্কুলেই ভর্তি করা হবে। আর গুরুতর প্রতিবন্ধীদের ভর্তি করা হবে সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত বিশেষ স্কুলে।
দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বছর তিনেক ধরে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে 'একীভূত শিক্ষা' কর্মসূচির আওতায় গুরুতর প্রতিবন্ধী ছাড়া সাধারণ ও মাঝারি ধরনের প্রতিবন্ধী শিশুদের সাধারণ স্কুলে ভর্তি করতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এত বছরেও এ জন্য সরকার কোনো নীতিমালা তৈরি করেনি। ফলে স্কুলগুলো প্রতিবন্ধীদের ভর্তির ক্ষেত্রে নানা বিভ্রান্তিতে পড়ছে। প্রতিবন্ধীদের সাধারণ স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই। এ ছাড়া প্রতিবন্ধীদের লেখাপড়া অব্যাহত রাখতে স্কুলগুলোর কিছুটা অবকাঠামোগত পরিবর্তনও দরকার। এর জন্যও সরকারি নীতিমালা প্রয়োজন।
প্রতিবন্ধীদের স্বেচ্ছাসেবা দিয়ে থাকে বি-স্ক্যান (বাংলাদেশি সিস্টেমস চেঞ্জ অ্যাডভোকেসি নেটওয়ার্ক)। সংগঠনের সহকারী প্রশাসক সালমা মাহবুব তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারি নীতিমালার অভাবে বহু বছর ধরে প্রতিবন্ধীরা সাধারণ স্কুলে পড়তে গিয়ে নানা সমস্যায় পড়ছে। সরকারি নীতিমালা থাকলে দৃষ্টি, চলৎ, বাক ও শ্রবণ_এই চার ধরনের মধ্যমমানের প্রতিবন্ধী শিশুরা কোন পদ্ধতিতে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই লেখাপড়া করতে পারবে এবং তাদের জন্য কী কী উপকরণের প্রয়োজন হতে পারে, তা স্পষ্ট হতো। প্রতিবন্ধী ছেলে-মেয়েদের সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করতে স্কুলগুলোরও তৈরি হতো বাধ্যবাধকতা। কিন্তু এর অভাবে সর্বত্র বিপত্তি দেখা দিচ্ছে।
সালমা মাহবুব উদাহরণ দিয়ে বলেন, চলতি জানুয়ারিতেই চট্টগ্রামের রেসিডেন্সিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একজন চলৎ প্রতিবন্ধী ছাত্রী সপ্তম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হয়। কিন্তু তার নতুন শ্রেণীকক্ষটি ছিল দোতলায়; ফলে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে তার ক্লাস করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। প্রয়োজনীয় সরকারি নীতিমালা না থাকায় তার পড়াশুনা নিয়ে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। পরে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপাধ্যক্ষ উদ্যোগী হয়ে অষ্টম শ্রেণীর ক্লাসটি নিচতলায় নামিয়ে আনায় এ সমস্যার সমাধান হয়।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সাধারণ স্কুলে প্রতিবন্ধী শিশুদের লেখাপড়ার সুযোগ সৃষ্টির জন্য জনসচেতনতা তৈরি করতে 'সবার জন্য শিক্ষা' কর্মসূচির আওতায় ২০০৬ সালে সরকার 'একীভূত শিক্ষা' প্রকল্প গ্রহণ করে। এই প্রকল্পের আওতায় গত তিন বছরে উপজেলা পর্যায়ের সরকারি, আধাসরকারি ও সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ১২৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিনিধিকে (প্রধান শিক্ষক বা সহকারী প্রধান শিক্ষক) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ের আরো ৩৭৯টি একই ধরনের স্কুলের শিক্ষক প্রতিনিধিকে এই প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
এ ছাড়া প্রতিবন্ধীদের স্কুলে ভর্তির জন্য শিক্ষাঙ্গনের অবকাঠামোগত উন্নয়নে একেকটি স্কুলকে ১০ হাজার টাকা প্রাথমিক বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এই টাকায় স্কুলগুলো হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী শিক্ষার্থীর জন্য ঢালু পথ (র‌্যাম্প) নির্মাণ, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য শ্রেণীকক্ষের পাঠ বারবার শোনার জন্য টেপ রেকর্ডার কেনা ইত্যাদি খাতে ব্যয় করবে।
প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০০৯ এবং প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন (সংশোধিত) ২০০৯-এর খসড়ায় গুরুতর প্রতিবন্ধী ছাড়া অন্য প্রতিবন্ধী শিশুদের সাধারণ স্কুলেই লেখাপড়ার সুযোগ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে।
১৯৯০ সালে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শিক্ষা সম্মেলনে ২০০০ সালের মধ্যে সব শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার আহ্বান জানানো হয়। পরে ১৯৯৩ সালে দিল্লীর জনসংখ্যা এবং ২০০০ সালে সেনেগালের ডাকারে অনুষ্ঠিত শিক্ষাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার 'সবার জন্য শিক্ষা' কর্মসূচি গ্রহণ করে। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথে ২০০৬ সালে কন্যা, দরিদ্র, প্রতিবন্ধী ও আদিবাসী_প্রাথমিক শিক্ষাবঞ্চিত এই চার ধরনের শিশুকে 'একীভূত শিক্ষা' কর্মসূচির আওতাভুক্ত করা হয়। আর ২০১১ সালের মধ্যে পুরো কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্য ধরা হয়।
১৯৮৫ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, দেশের প্রায় দেড় কোটি মানুষ নানাভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার; যা মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ। এরপর আর কোনো সরকারি-বেসরকারি জরিপ না হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, বর্তমানে এই সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি।

লেখকঃ বিপ্লব রহমান
http://www.kalerkantho.com/

 
Design by Oronno Anam | Bloggerized by Salma Mahbub