তাদের জানতে-বুঝতে আপনি যা করতে পারেন

অনাদরে, অবহেলায় মরে গেল আমার ভাই, জেমস। তার জন্ম ১৯৪৩ সালে। জেমসের একধরনের বংশগত অস্বাভাবিকতা ছিল, যাকে বলা হয় ডনস সিনড্রোম। গুরুতর শিখনপ্রতিবন্ধিতা ছিল। ১৯৯৯ সালে ব্রিটেনে মারা যাওয়ার আগে সে মারাত্মক নিউমোনিয়া বাঁধিয়ে ফেলেছিল। তার সমস্যাটা খুঁজে পেতে চিকিৎসকেরা যথেষ্ট সময় ও কষ্ট স্বীকার করতে চাননি। ডায়রিয়া হয়েছিল। যে আবাসিক পরিচর্যাকেন্দ্রে সে থাকত, তা যথাযথভাবে যাচাই না করেই তারা শুধু ডায়রিয়ার চিকিৎসা করল। প্রতিবন্ধীদের দেখাশোনার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক ও পরিচর্যাকারীদের সঙ্গে সে যোগাযোগ করতে পারেনি। তাই সে মরে গেল। তার জন্মদিন ৩ ডিসেম্বর। এ দিনটি আমার কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
যেসব মানুষের জীবন এক বা একাধিক প্রতিবন্ধিতার কারণে বেশির ভাগ মানুষের চেয়ে অনেক কঠিন, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, অনুভূতি বোঝার চেষ্টা আমরা কি কখনো করেছি? এই প্রশ্ন নিজেকেই করা দরকার। তাদের প্রতি আমাদের আচরণ কেমন হতে পারে, আমরা কী করব বা বলব, তা না জানার কারণে প্রায়ই আমরা বিব্রত ও ক্লেশ বোধ করি। এখানে কিছু প্রায়োগিক পরামর্শ আমি লিখছি, যা হয়তো প্রতিবন্ধীদের অনুভূতি বুঝতে সহায়ক হবে। এগুলো আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তুলে আনা। আমার বেড়ে ওঠার সময়ে পাশে ছিল গুরুতর শিখনপ্রতিবন্ধী ভাই আর পরবর্তী জীবনে আমার এক ছেলেরও এ ধরনের প্রতিবন্ধিতা ছিল। এর বাইরেও বহু প্রতিবন্ধীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুতা আমার জীবন ও কর্মকে সমৃদ্ধ করেছে।
১৯৯০-৯১ সালে বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিবন্ধী নীতির প্রথম খসড়া দাঁড় করানোর জন্য আরও কয়েকজনের সঙ্গে যুক্ত থাকা এবং এ ক্ষেত্রে অগ্রগতির ধীরগতি দেখার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, প্রতিবন্ধীদের নানা সমস্যার বিষয়ে কর্তাব্যক্তিদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন। সরকারের বেশির ভাগ বাজেট-পরিকল্পনায় প্রতিবন্ধীদের অধিকার স্থান পায় একদম শেষে। বহু কাজ এখনো করা বাকি। তাই আমি তাগাদা দেব এগুলো সম্পন্ন করুন। আমি বেশ আনন্দিত, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যেসব বিপদের মুখে পড়ে, সেগুলোর ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার আন্তরিক আগ্রহ দেখাচ্ছে। বাংলাদেশসহ বহু দেশে অনেক প্রতিবন্ধী বন্ধুর সঙ্গে আমি কাজ করেছি। আর সব সময় আমি চেষ্টা করেছি প্রতিবন্ধিতা নয়, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ওপর মনোযোগ দিতে। আশা করি, নিচে যে পরামর্শগুলো তুলে ধরছি, সেগুলো মন্ত্রী ও সরকারি কর্মী বাহিনীকে প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে করণীয় আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে। অবশ্য সর্বোত্তম পরামর্শ হলো, কোনো প্রতিবন্ধীর সঙ্গে আপনি কেমন সম্পর্ক করবেন, তা নিয়ে দ্বিধা থাকলে তার কাছেই পরামর্শ চান।

কারও যদি এক ধরনের প্রতিবন্ধিতা থাকে, তার সঙ্গে এমন আচরণ করা যাবে না, যাতে মনে হয় সে অন্য অনেকভাবে প্রতিবন্ধী। হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীর সঙ্গে এক সিলেবলের সরল শব্দে কথা বলা, শ্রবণপ্রতিবন্ধীকে চিৎকার করে কিছু বলা এবং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর সঙ্গে কথা বলার সময় অন্য কারও মাধ্যমে কথা বলার প্রবণতা দেখা যায়।

কোনো ব্যক্তির প্রতিবন্ধিতার ওপর নয়, ব্যক্তিটির ওপরই মনোযোগ দিন। যদি মনে হয় কোনো প্রতিবন্ধীর সাহায্য প্রয়োজন, তবে তাকে জিজ্ঞাসা করুন, আপনি সাহায্য করতে পারেন কি না এবং কীভাবে তা করা যায়। সাহায্য করার কথা বলতে আপনার দ্বিধা থাকতে পারে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরও সাহায্য চাইতে দ্বিধা থাকতে পারে। প্রতিবন্ধীরা সাধারণত যতটা সম্ভব স্বাধীন থাকতে চায়। তাই যদি আপনার সাহায্যের দরকার না লাগে, তাতে অপমানিত বোধ করবেন না এবং অন্য কোনো সময় সাহায্য করতে চাওয়া থেকে বিরত থাকবেন না। কখনো বলবেন না, ‘আমি যদি তুমি হতাম, তাহলে এই চেষ্টা করতাম না’—কোনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কী করতে পারে বা না পারে, তা সাধারণত সে-ই সবচেয়ে ভালো বিচার করতে পারে। করুণা দেখাবেন না। এমন কথা বলবেন না, ‘তুমি যে কীভাবে চালিয়ে নিচ্ছ; হাঁটতে না পারলে আমি তো মরেই যেতাম।’ এমন কথা প্রায়ই আহত করে এবং প্রশংসার আড়ালে নিজের ভিন্নতার বোধই জাগিয়ে তোলে।

যে শিশুর প্রতিবন্ধিতা আছে, তার সঙ্গে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক আচরণ করুন। অন্য শিশুদের মতোই তাদের কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে দেবেন না। অন্য শিশুর মতোই প্রতিবন্ধী শিশুদেরও সমাজের গ্রহণযোগ্য আচরণের সীমা জানা দরকার।

বিলম্ব না করে আপনার পরিচয় জানিয়ে দিন। ‘হ্যালো’ বা অন্য কোনো সম্ভাষণ শুনেই আপনার অবস্থান সম্পর্কে ধারণা করা একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর জন্য সব সময় সম্ভব হয় না। সে যদি আপনার পরিচয় না বুঝতে পারে, তাহলে তার পক্ষে আন্তরিকভাবে সম্ভাষণের জবাব দেওয়া মুশকিল। সুতরাং, আপনার পরিচয় দিন এবং প্রাসঙ্গিক কোনো ঘটনা বর্ণনা করুন—যেমন, ‘হ্যালো, আমি তাসনিম। গত সপ্তাহে ফরিদার বাড়িতে আপনার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল।’ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির নাম মনে রাখতে বিশেষ যত্ন নিন। তাকে উদ্দেশ করে কথা বলা হচ্ছে, এটা বোঝানোর জন্য তার নাম বলে কথা শুরু করাই একমাত্র পথ।

কোনো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর উদ্দেশে ‘আপনাকে দেখে ভালো লাগল’-জাতীয় কথা বলতে দ্বিধা বোধ করবেন না। সেও হয়তো একইভাবে উত্তর দেবে। দেখা-সম্পর্কিত শব্দ পরিহার করা অসম্ভব—দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা এ ধরনের শব্দ ব্যবহারে খুব বেশি আত্মসচেতন নয়, হওয়ার দরকারও নেই।
অপ্রত্যাশিতভাবে কোনো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর হাত ধরবেন না। তাতে সে ভয়ে চমকে উঠতে পারে। আসলে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীকে ধরবেন না, তাকেই সুযোগ দিন আপনার হাত ধরার। তখন সে নিশ্চিন্তে আপনার থেকে অর্ধেক পদক্ষেপ পেছনে থাকবে এবং এভাবে সে বুঝতে পারবে, আপনার পরের পদক্ষেপে কতটা জায়গা বদল হচ্ছে। ‘এই এক কদম’, ‘সামনে পা ফেলুন’, কিংবা ‘একটু পেছনে যান’—এজাতীয় কথা বলবেন না। নিচের দিকে নামার সময় পা শূন্যে দোলাতে থাকা যেমন বিপজ্জনক, তেমনি অস্বস্তিকর। উঁচু-নিচু পথে চলার সময় তা তাকে অবহিত করুন।
দরজা কখনো অর্ধেক খোলা রাখবেন না। পুরোপুরি বন্ধ রাখুন, নয়তো একদম হাট করে খুলে রাখুন। টেলিভিশন দেখা থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীকে দূরে সরিয়ে রাখবেন না। তার দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন বন্ধুদের জানা দুনিয়ায় প্রবেশের রাস্তা এই টেলিভিশন। বাইরের কর্মকাণ্ড থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বন্ধুকে বাদ দেবেন না। তার বাজার আপনি করে দেওয়ার বদলে তাকে জিজ্ঞাসা করুন আপনার সঙ্গে সেও বাজার করতে চায় কি না।

কোনো শিখনপ্রতিবন্ধীর কাছে কোনো শিশু গেলে তাকে খেদিয়ে দেবেন না। (প্রায়ই ভুলবশত শিখনপ্রতিবন্ধীদের বলা হয় ‘মানসিক প্রতিবন্ধী’)। শিখনপ্রতিবন্ধীদের ভয় পাবেন না। তারা সাধারণত সহিংস হয় না। আর তারা যদি অনেকের মাঝে বাস করে, তাহলে ধরে নিতে পারেন, তারা সহিংস আচরণ করবে না। শিখনপ্রতিবন্ধীদের এড়িয়ে যাওয়া বা প্রত্যাখ্যান করাই সাধারণত তাদের মেজাজ বিগড়ে দেওয়ার প্রধান কারণ। তাদের সঙ্গে সৎ আচরণ করতে হবে, প্রতিশ্রুতি রাখতে হবে। শিখনপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি আপনার প্রতিশ্রুতি বোঝে না কিংবা মনে রাখে না—এমন মনে করবেন না। উদাহরণ হিসেবে বলি, আমার শিখনপ্রতিবন্ধী ছেলে নিলের বয়স এখন ৩২; তার স্মৃতিশক্তি বিস্ময়কর এবং নিজের অবস্থান বা লক্ষ্য সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান তার আছে।
মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির কথা সময় নিয়ে শুনুন। ভাববেন না, তার কোনো জ্ঞান বা মত নেই।
প্রতিবন্ধী সন্তানের মা-বাবার প্রতি করুণা প্রকাশ করবেন না। মা-বাবার কাছে সব সন্তানই প্রিয়। কাউকে উপদেশ দিতে যাবেন না। তবে যদি পেশাগত দিক থেকে কাউকে কোনো নির্দেশনা না দেওয়া হয় এবং তাকে সাহায্য করা আবশ্যক মনে হয়, তখনই কেবল তাকে উপদেশ দিন। মনে রাখবেন, আপনি কোনো প্রায়োগিক সহায়তা দিতে চাইলে দীর্ঘ সময় ধরে তা দিতে হতে পারে। মানসিকভাবে অসুস্থ কাউকে বলবেন না, ‘সংযত হও’। তারা যদি তা পারত, তাহলে তো করতই।
আপনাকে যদি হুইলচেয়ার না ধরতে বলে, তাহলে ধরবেন না। অনভিজ্ঞ কেউ ধরলে চেয়ারে বসা ব্যক্তি সহজেই ছিটকে পড়তে পারে। দ্রুত চেয়ার ঘোরাতে গেলে তাকে সতর্ক করার কথা মনে রাখতে হবে। আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ আগেই তাকে জানানো দরকার। আপনি যে গতিতে চেয়ারে ধাক্কা দিচ্ছেন, তাতে হুইলচেয়ারে বসা ব্যক্তি কতটা স্বস্তি বোধ করছে, তা খেয়াল করতে হবে। হাত রাখার জায়গায় ধরে চেয়ারটি তুলবেন না, তাহলে হয়তো হাতল আপনার হাতে চলে আসবে। মনে রাখবেন, আপনি উৎফুল্ল চিত্তে যা বলছেন, তা চেয়ারে বসা ব্যক্তিটির পক্ষে শোনা কঠিন হতে পারে। কেননা, আপনার কথা পেছন থেকে আসায় যানবাহনের শব্দের সঙ্গে পেরে উঠবে না। তা ছাড়া তার অবস্থান থেকে সে হয়তো দেখবে না, আপনি কোন দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছেন।
স্থির হুইলচেয়ারে বসা ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার সময় আপনার মাথা একই স্তরে রাখুন। নিচের দিকে চেয়ে কথা বলা এবং ওপরের দিকে চেয়ে শোনা সব সময় অস্বস্তিদায়ক। সিঁড়ি দিয়ে হুইলচেয়ার কীভাবে নামানো বা ওঠানো যায়, তা চেয়ারে বসা ব্যক্তির কাছে জানতে চান, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সাধারণত সোজা কোনো কৌশল জানে।

শ্রবণপ্রতিবন্ধীর সঙ্গে কথা বলার সময় আপনার চেহারা যেন সে স্পষ্ট দেখতে পায়। আপনি আলো বা জানালার বিপরীতে মুখ করে দাঁড়ালে আপনার ছায়া পড়তে পারে। আপনার ঠোঁটের নড়াচড়া পড়ে বোঝার জন্য যতটা বিস্তারিতভাবে দেখা দরকার, তা তখন সম্ভব হয় না। কথা বলার সময় নড়াচড়া কম করবেন, না হলে কিছু কথা হারিয়ে যাবে। ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে কথা বুঝতে সাহায্য করার জন্য মুখ বিকৃত করবেন না। যেসব সূক্ষ্ম চিহ্ন থেকে সে অর্থ তৈরি করে, তা মুখের এমন কসরতের ফলে হারিয়ে যায়। আর চিৎকার দিয়ে কথা বলবেন না। তাতে কাজ হয় না, বরং শ্রুতিসহায় যন্ত্রের ক্ষতি হতে পারে।

মনে রাখবেন, শ্রবণপ্রতিবন্ধী কোনো ব্যক্তি অন্ধকারে বাইরে যেতে ভয় পেতে পারে। ঘরের ভেতরে নিরাপদ আলো পাওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করুন। রাতের বেলা আপনার সঙ্গী যদি কোনো শ্রবণপ্রতিবন্ধী হয়, তাহলে সঙ্গে করে টর্চ নিতে ভুলবেন না। তাকে কিছু বলার সময় আপনার মুখে আলো ফেলবেন। শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি কী বলতে চাচ্ছে, তা যদি না ধরতে পারেন, কিংবা তার শ্রুতিসহায় যদি বাঁশি বাজার মতো শব্দ করতে থাকে, তাহলে চুপ করে থাকবেন না, অকপটে বলুন। নইলে কেমন করে সে বুঝবে?

কাউকে ছোট করে দেখবেন না। শ্রবণপ্রতিবন্ধীর কণ্ঠ অদ্ভুত মনে হতে পারে, কিন্তু এমন ভাব করার দরকার নেই যে তার শিখনপ্রতিবন্ধিতাও আছে।
গান বাজান। শ্রবণপ্রতিবন্ধীরা স্পন্দন অনুভব করে বিট ‘শুনতে’ পারে। শ্রবণপ্রতিবন্ধী কিশোর-কিশোরীরা গানের সঙ্গে নাচতে পছন্দ করে। যত উচ্চ স্বরে গান, তত ভালো।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
জুলিয়ান ফ্রান্সিস: সমাজকর্মী, দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত।

সুত্রঃ প্রথম আলো, ০৩-১২-২০১০
http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-12-03/news/112897

0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment

 
Design by Oronno Anam | Bloggerized by Salma Mahbub