পাহাড় জয়ের গল্প

পাহাড়-পর্বতে ওঠা চাট্টিখানি কথা নয়। এর জন্য প্রয়োজন কঠোর অনুশীলন আর শারীরিক সক্ষমতা। পাহাড়ের পদে পদে জড়ানো রয়েছে বিপদ আর মৃত্যুর হাতছানি। মৃত্যু এখানে খুব সহজ ও স্বাভাবিক একটি বিষয়। তার পরও জেদি আর একরোখা মানুষ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে না। নেশা কিংবা শখের বশে জয় করতে চায় পাহাড়। হোক না মৃত্যু। পাহাড়ে উঠতে গিয়ে বীরের মতো মরণকে বেছে নেওয়াই যেন ভালো। পাহাড় জয় করার জন্য এ ত্যাগটুকু স্বীকার করতে ওদের বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। এমন সব ভাবনা আর নেশার বশে ফি-বছর কিছু লোক যাত্রা করে কিলিমানজারোর দিকে। আফ্রিকার সবচেয়ে উঁচু পর্বত। পাহাড়ে চড়া মানুষের কাছে এ পর্বতটি অতি প্রিয়। শারীরিকভাবে সক্ষম এবং পাহাড়ে চড়ার কসরত সম্পর্কে জানা ঝানু লোকজনের কাছে বড্ড রোমাঞ্চকর এ যাত্রা। ১৭ হাজার ৩৪০ ফুট দূরত্ব অতিক্রম করতে গিয়ে প্রায়ই হার মেনে বসে আরোহীরা। তাই সাহসী আর সবল মানুষই শুধু দলে দলে যাত্রা করে এ পাহাড়টির দিকে। এই মানুষজনের ভিড়েই যদি কোনো এক পর্বতারোহী মাত্র একটি পায়ে ভর করে পাহাড়ের কঠিন বুকে পা ফেলে ফেলে উঠে যায় ওপর থেকে ওপরে, তখন অবাক হতে হয়। এক পা নিয়ে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরাটাই যেখানে কষ্টকর, সেখানে পাহাড়ে ওঠাটা দুঃসাহসের শামিল। আর এমন দুঃসাহসিক কাজটিই করেছেন সারাহ ডোহার্টি। তিনি কিলিমানজারোর উদ্দেশে যাত্রা করে হয়েছেন সফল। একটি মাত্র পা নিয়ে জয় করেছেন কিলিমানজারো। আজকের গল্পটা সারাহ ডোহার্টিকে নিয়ে। পাহাড়ে ওঠার পেছনে তাঁর কষ্টসাধ্য পরিশ্রম আর সংগ্রামের কথাগুলোই শুনব আমরা আজ।

মুক্তির স্বাদ
সারাহকে পাড়ার সবাই দস্যি মেয়ে হিসেবেই জানে। দিনমান দৌড়ঝাঁপ করেই কাটে তাঁর সময়। সাঁতার কিংবা সাইকেল চালানো, সবকিছুতেই বন্ধুদের চেয়ে সেরা সারাহ ডোহার্টি। এসব দস্যিপনা করতে করতেই একদিন ঘটে যায় একটি দুর্ঘটনা। সড়ক দুর্ঘটনায় হারাতে হয় নিজের ডান পা। এর পরের দিনগুলো ছিল বড় যন্ত্রণার। চলাফেরার স্বাধীনতা যেন হারিয়ে যাচ্ছিল দিনকে দিন। তবে সারাহ ভেঙে পড়ার মতো মেয়ে নন। তাই পা হারানোর পর বলছিলেন, ‘আমি জানি, কিছু স্বাধীনতা আমি হারিয়েছি, তাই বলে সাধারণ সুস্থ মানুষের মতো জীবন যাপন করা থেকে বঞ্চিত হতে চাই না কখনো।’ নিজের ক্রাচ নিয়ে ২০০৪ সালের দিকে ৭২০ কিলোমিটার ট্রেকিং করেন সারাহ। এর পরই বেড়ে যায় অত্মবিশ্বাস। শৈশব থেকেই ছিল পাহাড়ে চড়ার নেশা। তাই মনস্থির করলেন, কিলিমানজারোর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করবেন। রেইনার ও আলাস্কা পর্বতে ওঠার অভিজ্ঞতা জমা আছে তাঁর ঝুলিতে; বুকের ভেতর নেই সাহসের কোনো কমতি। ধীরে ধীরে সম্পন্ন করা হলো পাহাড়ে ওঠার প্রস্তুতি। নিজের তিন ছেলেমেয়ের অনুমতি নিয়ে শুরু হলো যাত্রা। সারাহর সঙ্গী হিসেবে রওনা হলেন তাঁরই যমজ বোন সুসান গ্যাব্রিয়েল। একটি পা নিয়ে এমন দুঃসাহস দেখানোর কারণে দুয়োধ্বনি তুলছিল নিন্দুকেরা। সারাহ এসবে কান দেননি। এতে শুধু সময়ের অপচয় হয়। প্রথমে তাঁরা পৌঁছালেন কিলিমানজারোর কাছাকাছি তানজানিয়ান গ্রাম মারাঙ্গুতে। পথে ঝামেলা হয়নি কোনো। শুধু পরিশ্রমের ফলে মাঝেমধ্যে মাথায় ব্যথা হতো সারাহ ডোহার্টির। যন্ত্রণা ভুলতে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটছিল ঘুমিয়ে। গ্রামটিতে কিছুদিন জিরিয়ে নেওয়ার পর রওনা হন কিলিমানজারোর দিকে। সামনে আর থামার ইচ্ছা নেই তাঁর। কঠিন এক গোঁ ধরেছেন সারাহ। যেভাবেই হোক, জয় করতে হবে কিলিমানজারো। তাই শুরু হয়ে গেল রোমাঞ্চকর এক যাত্রা।

কিলিমানজারো
১৬ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতায় ওঠার পর সবার মনে জেঁকে বসে হাইপোথারমিয়ার ভয়। কিন্তু থেমে থাকতে রাজি নন সারাহ। একবার থেমে গেলে হয়তো উবে যাবে ভেতরের সব উদ্দীপনা, উৎসাহ। বিশেষভাবে তৈরি অ্যালুমিনিয়ামের ক্রাচ নিয়ে পোহাতে হয়েছে অনেক ঝামেলা। কিলিমানজারোর আবহাওয়ায় নিজেকে মানিয়ে নিতেও কষ্ট হচ্ছিল খুব। চূড়ার একদম কাছাকাছি গিয়ে ঘটল আরেক দুর্ঘটনা। বাঁ পায়ের ক্রাচটি গেল ভেঙে। ভরসা করতে হলো গাইডের ওপর। তার কাঁধে ভর দিয়ে দিয়ে এগোতে হলো অনেক কষ্টে। পথিমধ্যে ক্যাম্প থেকে মেরামত করা হলো ক্রাচটি। গিলসম্যান পয়েন্টে ওঠার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন সারাহ। লক্ষ্যে পৌঁছাতে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না তাঁকে। অতিক্রম করতে হবে সামান্য কিছু দূরত্ব। সর্বোচ্চ উচ্চতায় যেতে হলে পৌঁছাতে হবে ১৯ হাজার ৩৪০ ফুট উচ্চতায়। কিছু সময় পর ক্রাচে ভর দিয়ে যখন সেখানে পৌঁছালেন সারাহ, তখন আনন্দে চিৎকার শুরু করলেন গাইড আর সঙ্গী যমজ বোন। বিজয়ের আনন্দে জল ভিড় করল সারাহর চোখে। স্বপ্নটা সত্যি হলো অবশেষে। বড্ড ক্লান্ত এখন তিনি। প্রয়োজন বিশ্রাম। প্রয়োজন একটুু আরামের ঘুম শেষে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা কফি। ‘ও আসলেই একটা অসাধারণ কাজ করেছে। পুরো অভিযানে বোনের পাশে থেকে ধন্য আমি। ডোহার্টির এই সাহস দেখে সত্যিই অবাক হয়েছি।’ হাসতে হাসতে বলছিলেন যমজ বোন সুসান। পাহাড় থেকে ফিরে এসে দিনগুলো কাটছে আনন্দে। চারপাশে শুধু সারাহকে ঘিরে উৎসব। এমন সফলতায় আনন্দিত সবাই।
বয়স ৫০ হতে চলল সারাহ ডোহার্টির। নিজের সন্তানেরাও বেড়ে উঠছে ধাই ধাই করে। চেহারায় তবু বার্ধক্যের ছাপ নেই সাহসী সারাহর। তাঁর মতে, সবে তো শুরু হলো জীবনটা। সামনে যেতে হবে আরও নতুন নতুন অভিযানে। জয় করতে হবে অজানা পৃথিবীটা।


ওয়েবসাইট অবলম্বনে


কিঙ্কর আহ্সান 

সুত্রঃ ছুটির দিনে, প্রথম আলো, ২৫/৯/২০১০।

0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment

 
Design by Oronno Anam | Bloggerized by Salma Mahbub