সিলসিলা ও সালমাদের স্বাস্থ্যকুশল - অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী

সিসিলা অনেক দিন ধরেই বলছিল, স্যার, আমাদের নিয়ে কিছু লিখুন।
বলেছিল সালমাও, ঢাকা থেকে।
সিসিলা চট্টগ্রামে থাকে, সালমা ঢাকায়।


মিষ্টি দুটি মেয়ে। হুইলচেয়ারে বসেছিল বাংলা একাডেমীতে বইমেলায় নজরুলমঞ্চের সামনে।
নিজের কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। অন্যের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করতে হবে। আর বইমেলায় প্রতিবারই আসি, অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। সেদিনও এসেছিলাম। সালমা মুঠোফোনে ডাকল, স্যার, এই যে আমরা নজরুলমঞ্চের সামনে। এলাম। দেখলাম, খুব মিষ্টি দুটো মেয়ে। সালমা ও সিসিলা। সালমার নাকি ছোটবেলায় পোলিও হয়েছিল। ক্রমে একদিন অবশ হলো শরীর। প্রতিবন্ধী হতে হলো। কিন্তু কী অসম্ভব মনের জোর। শাণিত বুদ্ধি সালমার। মনে হতাশা নেই। সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কী প্রবল ইচ্ছা এবং সে এতে জয়ীও হয়েছে।


সিসিলাও কম যায় না। দেহের পেশিতে ব্যাধি ভর করেছে। নিশ্চল শরীর নিচের দিকে, তবু অদ্ভুত সুন্দর মুখশ্রী সিসিলার। পৃথিবী জয়ের হাসি তার ঠোঁটে। সুস্থ থাকা যে কত বড় আশীর্বাদ, তা এদের না দেখলে বোঝা যায় না।


ওরা বেশ কয়েকজন জড়ো হয়েছিল রমনা পার্কে, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার জন্য। প্রতিবন্ধী হলেও এরা নিজের জোরেই উঠে এসেছে অনেকখানি।
আমরা এদের দিকে অবলম্বন ও সাহায্যের হাত বাড়ালে অনেকটা করা হবে। এরা করুণা চায় না। তারা অন্যদের মতো অধিকার চায়।


শিক্ষার অধিকারও চায় তারা অন্যদের মতো। প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের জন্য লিফট, র‌্যাম্প নেই অনেক স্কুলে। আলাদা ব্যবস্থা নয় এবং এদের অধিকার রয়েছে শিক্ষাগ্রহণের—একে মর্যাদা দেওয়া।
স্টিফেন হকিংয়ের কথা বলি। তিনিও প্রতিবন্ধী। তাই তো! তবু হকিং অত্যন্ত বড় মাপের বিজ্ঞানী। সমসাময়িক সময়ে তাঁর মতো বড় বিজ্ঞানী একজন দেখান তো! এমন আরও উদাহরণ রয়েছে।
ওদের স্বাস্থ্যের দেখভাল করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা কি করা যায় না?
নিজেরাই করবে, তবু তাদের এগুলো জোগান দেওয়া। একটু পাশে এসে দাঁড়ালেই তারা অনেক খুশি। মনের জোর তাদের এতে আরও বাড়বে।


ওরা আমার কাছে এসেছিল।
ওদের কথা, একটু লিখুন আমাদের জন্য।
আমাদের অধিকার অর্জনের জন্য পাশে এসে দাঁড়ান।


সালমা সেদিন আসেনি, এসেছিল সিসিলা ও জলছবি। প্রতিবন্ধী নয়, এমন আরও দুজন বন্ধুও এসেছিল। তাদের একজন বহ্নি, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। অন্যজন অরণ্য, সঙ্গে ছিল সাংবাদিকও। এ দুটো ছেলেমেয়ে জীবনকে ভালোবেসে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অনেক পরিকল্পনা তাদের।
বিশেষ করে, প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়ে যারা, তাদের জন্য শিক্ষার অধিকারকে আরও জোরালোভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা। সমানভাবে তাদের দেখা, তাদের শিক্ষাগ্রহণকে সুগম করার জন্য স্কুলে লিফট, র‌্যাম্প—এসব রাখা। তাদের স্বাস্থ্যের যে সমস্যা, অসুবিধা, সেগুলো দেখভালের জন্য, পরিচর্যার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা চাই।


ওরা ফিরে যাচ্ছে নিজেদের ঘরে। ফটো তুলেছে আমার সঙ্গে।
মুখে তাদের হাসি।
সন্ধ্যা হয় হয় অবস্থা।
তাদের হাসি ছুটে যায় গোধূলির মিছিলে।
এক নতুন সূর্য ওঠা ভোরে তারা দেখবে জয়। প্রতিবন্ধী হলেও স্বাভাবিক মানুষের মতো তারা মর্যাদা পেয়েছে, পেয়েছে ন্যায্য অধিকার।
ওরা ফেসবুকে অনলাইন গ্রুপ করেছে। হয়তো আরও অনেকে এদের পাশে এসে দাঁড়াবে। ছড়িয়ে যাবে তাদের বার্তা আরও ব্যাপকভাবে। অর্জিত হবে তাদের অধিকার। জনপ্রিয় এই সরকার তাদের দেবে অধিকার—সে আশা তাদের সবার।
শেষে কথা বলি।


সিসিলা ও জলছবি যখন বারডেম ছেড়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ করে মনে হলো তাদের একটা কথা। স্যার, আমরা সমবেদনা চাই না, সহানুভূতি চাই না, দয়া চাই না। আমরা চাই সমমর্মিতা। তখনই বারডেমের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ইব্রাহিমের কথা মনে হলো। তিনি বলতেন, একটি কথা: Sympathy নয়, 'Empathy' সমমর্মিতা। অসুখে মানুষ চায় সমমর্মিতা। এমন যে; নিজের যদি এমন কষ্ট হয়, অসুখ হয়, অবস্থা হয়, তাহলে কেমন লাগে—তা উপলব্ধি করলে অন্যের দুঃখটা বোঝা যায়। নিজের মধ্যে অন্যের কষ্টটা বসিয়ে দিলে বোঝা যায় অন্যের কষ্ট কত! সিসিলাকে বলা হয়নি রবিঠাকুরের সেই কথা—বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা/বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
ওরা জানে কীভাবে ভয়কে জয় করতে হয় (They will overcome). 


সুত্রঃ প্রথম আলো, ২৫ আগস্ট, ২০১০।

0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment

 
Design by Oronno Anam | Bloggerized by Salma Mahbub