'অনেকক্ষণ বৃষ্টি থেমে গেছে। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ।’
রামবসুর কবিতার পঙিক্ত। পরের পঙিক্তটি ‘খোকাকে শুইয়ে দাও’।
সত্যিই বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু কোহিনূর বেগম তাঁর ‘খুকি’দের কোথাও শুইয়ে দেওয়ার কথা ভাবতে পারছেন না। প্রতিবন্ধীরা চালাতে পারে এমন একটি ত্রিচক্রযানের সঙ্গে দুটো রশি আর ধানমন্ডি লেকের রেলিংয়ে দুটো রশি টানিয়ে নীল রঙের একটি পলিথিন রেখেছেন মাথার ওপর। বৃষ্টির ঝাপটা থেকে বাঁচার এই ছিল তাঁর উপায়। সিমেন্টের ফুটপাতে শিশু দুটিকে শুইয়ে দেওয়া যায় না। সুতরাং কোহিনূরের নয় বছরের নিশি আক্তার রুমানা আর সাড়ে তিন বছরের ফাতেমাতুজ জোহরা নামের দুটি মেয়ে ওই নীল চাদোয়ার নিচেই মায়ের সঙ্গে বসে আছে।
‘আপনার কী হয়েছে?’
‘টাইফয়েড হইছিলো পনেরো বছর আগে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত সমস্যা।’
শিশু দুটিকে দেখিয়ে বলি, ‘ওদের বাবা কোথায়?’
‘ওগো বাবা আরেকটা বিয়া করছে। আমারে ছাড়ে নাই। কোথায় আছে, বলতে পারব না। এক বছর তার কোনো ঠিকানা নাই।’
ধানমন্ডি লেকের পাড়ে, রুশ বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি কেন্দ্রের কাছে, এটি ওদের অস্থায়ী ঠিকানা। কামরাঙ্গীরচরে বাড়ি। ভোর ছয়টায় দুই শিশুকে ডাল-ভাত খাইয়ে ত্রিচক্রযানটিতে করে তিনজনই এসে পড়ে ধানমন্ডিতে। বড়টা সুরভি স্কুলে পড়ে। কোহিনূর বেগম কী করেন তবে? ‘ভিক্ষা করি। সাহেবরা দান করে।’ বললেন তিনি।
‘রান্না করেন কখন?’
‘রাইতে বাড়ি ফিরা। রান্না করুম না? বাচ্চারা খাইলে রান্না করতে হয় না? দিনের বেলায় হোটেল থিকা ২৫ টাকার ভাত-সবজি আইন্না তিনজন খাইয়া লই। ওই যে দ্যাহেন, টিফিন কারিয়ার। ওইটাতেই ভাত লইয়া আসি।’
‘ভিক্ষা করেন কেন?’
‘কাজ দিবেন? কাজ দ্যান না কেন? আমি তো বইয়া বইয়া সবকিছু করতে পারি। আমারে একটা দোকান দিয়া দিলেই তো হয়। ভিক্ষা কি কোনো পেশা?’
মাঝেমধ্যে ঈদের পর বিক্রমপুরের বাড়িখালীতে পৈতৃক বাড়িতে বেড়াতে যান। কিন্তু বেশি দিন থাকেন না। ‘ওগো নানী আছে ওইখানে। কিন্তু হেরাও তো গরিব। বড়লোকরাই দেখে না! গরিবরে কে দেখব? বেশি দিন থাকন যায় না।’
‘ওদের বাবা যদি ফিরে আসে?’
‘বাবা ফিরা আইলে আসল, না আইলে নাই। বাপের আশা কে করে? আমি স্বপ্ন দেখি, ভবিষ্যতে আমার মাইয়া দুইটা বড় হইব। চাকরি করব। আমারে দেইখ্যা রাখব। আর শোনেন, ওগো বাপে ফিরল কি না-ফিরল, তাতে কিছু আসে-যায় না। কষ্ট কইরা খাইতে পারতাছি। বাকি দিনগুলাও পার কইরা দিতে পারমু।’
এ কথাগুলো যখন বলছিলেন কোহিনূর বেগম, তখন এই পঙ্গু মানুষটিকে অনেক বড় বলে মনে হয়। দুটি সন্তান নিয়ে যানজটের রাস্তা দিয়ে ত্রিচক্রযান চালিয়ে প্রতিটি দিন সংগ্রাম করে চলেছেন জীবনের সঙ্গে।
ফিরে আসতে আসতে দুটি বাক্য মাথায় ঘুরতেই থাকে: ‘কাজ দ্যান না কেন?’ আর ‘বাকি দিনগুলাও পার কইরা দিতে পারমু।’
বাক্য দুটির ভেতরকার শক্তি তাঁকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।
-জাহিদ রেজা নূর
সুত্রঃ প্রথম আলো, ছুটির দিনে, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০০৯।
রামবসুর কবিতার পঙিক্ত। পরের পঙিক্তটি ‘খোকাকে শুইয়ে দাও’।
সত্যিই বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু কোহিনূর বেগম তাঁর ‘খুকি’দের কোথাও শুইয়ে দেওয়ার কথা ভাবতে পারছেন না। প্রতিবন্ধীরা চালাতে পারে এমন একটি ত্রিচক্রযানের সঙ্গে দুটো রশি আর ধানমন্ডি লেকের রেলিংয়ে দুটো রশি টানিয়ে নীল রঙের একটি পলিথিন রেখেছেন মাথার ওপর। বৃষ্টির ঝাপটা থেকে বাঁচার এই ছিল তাঁর উপায়। সিমেন্টের ফুটপাতে শিশু দুটিকে শুইয়ে দেওয়া যায় না। সুতরাং কোহিনূরের নয় বছরের নিশি আক্তার রুমানা আর সাড়ে তিন বছরের ফাতেমাতুজ জোহরা নামের দুটি মেয়ে ওই নীল চাদোয়ার নিচেই মায়ের সঙ্গে বসে আছে।
‘আপনার কী হয়েছে?’
‘টাইফয়েড হইছিলো পনেরো বছর আগে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত সমস্যা।’
শিশু দুটিকে দেখিয়ে বলি, ‘ওদের বাবা কোথায়?’
‘ওগো বাবা আরেকটা বিয়া করছে। আমারে ছাড়ে নাই। কোথায় আছে, বলতে পারব না। এক বছর তার কোনো ঠিকানা নাই।’
ধানমন্ডি লেকের পাড়ে, রুশ বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি কেন্দ্রের কাছে, এটি ওদের অস্থায়ী ঠিকানা। কামরাঙ্গীরচরে বাড়ি। ভোর ছয়টায় দুই শিশুকে ডাল-ভাত খাইয়ে ত্রিচক্রযানটিতে করে তিনজনই এসে পড়ে ধানমন্ডিতে। বড়টা সুরভি স্কুলে পড়ে। কোহিনূর বেগম কী করেন তবে? ‘ভিক্ষা করি। সাহেবরা দান করে।’ বললেন তিনি।
‘রান্না করেন কখন?’
‘রাইতে বাড়ি ফিরা। রান্না করুম না? বাচ্চারা খাইলে রান্না করতে হয় না? দিনের বেলায় হোটেল থিকা ২৫ টাকার ভাত-সবজি আইন্না তিনজন খাইয়া লই। ওই যে দ্যাহেন, টিফিন কারিয়ার। ওইটাতেই ভাত লইয়া আসি।’
‘ভিক্ষা করেন কেন?’
‘কাজ দিবেন? কাজ দ্যান না কেন? আমি তো বইয়া বইয়া সবকিছু করতে পারি। আমারে একটা দোকান দিয়া দিলেই তো হয়। ভিক্ষা কি কোনো পেশা?’
মাঝেমধ্যে ঈদের পর বিক্রমপুরের বাড়িখালীতে পৈতৃক বাড়িতে বেড়াতে যান। কিন্তু বেশি দিন থাকেন না। ‘ওগো নানী আছে ওইখানে। কিন্তু হেরাও তো গরিব। বড়লোকরাই দেখে না! গরিবরে কে দেখব? বেশি দিন থাকন যায় না।’
‘ওদের বাবা যদি ফিরে আসে?’
‘বাবা ফিরা আইলে আসল, না আইলে নাই। বাপের আশা কে করে? আমি স্বপ্ন দেখি, ভবিষ্যতে আমার মাইয়া দুইটা বড় হইব। চাকরি করব। আমারে দেইখ্যা রাখব। আর শোনেন, ওগো বাপে ফিরল কি না-ফিরল, তাতে কিছু আসে-যায় না। কষ্ট কইরা খাইতে পারতাছি। বাকি দিনগুলাও পার কইরা দিতে পারমু।’
এ কথাগুলো যখন বলছিলেন কোহিনূর বেগম, তখন এই পঙ্গু মানুষটিকে অনেক বড় বলে মনে হয়। দুটি সন্তান নিয়ে যানজটের রাস্তা দিয়ে ত্রিচক্রযান চালিয়ে প্রতিটি দিন সংগ্রাম করে চলেছেন জীবনের সঙ্গে।
ফিরে আসতে আসতে দুটি বাক্য মাথায় ঘুরতেই থাকে: ‘কাজ দ্যান না কেন?’ আর ‘বাকি দিনগুলাও পার কইরা দিতে পারমু।’
বাক্য দুটির ভেতরকার শক্তি তাঁকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।
-জাহিদ রেজা নূর
সুত্রঃ প্রথম আলো, ছুটির দিনে, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০০৯।
0 মন্তব্য(সমূহ):
Post a Comment