রবীন্দ্র সরোবরঃ প্রথম আলো আয়োজন

অনেকদিন পর বিশাল খোলা আকাশটাকে দেখলাম। চারদেয়ালের মাঝে থেকে সহজে বের হওয়া আমার হয়ে উঠে না। পারিপার্শিক অবস্থাগুলো আমাদের অনুকুল নয় বলে, বের হতে ভাল লাগে না সেই ছোটবেলা থেকেই, কিন্তু আজ ভাবি বের না হলেও এই অবস্থা কোনদিন পাল্টাবে না। প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল রবীন্দ্র সরোবরে। পত্রিকায় দেখে ভাললাম, যাব এই অনুষ্ঠানে, কিন্তু চিন্তায় ছিলাম নিজের এই হুইলচেয়ারটিকে নিয়ে। আমরা তো কোথাও আমন্ত্রিত নই, তাই আমাদের কথা মাথায় রেখে কোন কিছু এই দেশে তৈরী হ্য় না। আরও একবার এখানে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে পিছিয়ে গিয়েছি। এবার যাবই ঠিক করলাম, টিভিতে যখন রবীন্দ্র সরোবর দেখেছি তখন ভেবেছি মঞ্চের কাছে না যেতে পারলেও, বসার স্থানগুলোর উপর থেকে হলেও আমি দেখতে পাব অনুষ্ঠান। সেই ভেবেই যাবার প্রস্তুতি।

সকাল বেলা ফেইসবুক অনলাইন এ আব্দুন নুর তুষার ভাই কে পেয়ে গেলাম। উনি প্রথম আলোর অনুষ্ঠানে যাবেন ধরে নিয়ে উনার কাছে জানতে চাইলাম, আমি কিভাবে যেতে পারি। উনি বললেন, লেইকের পাশ দিয়ে নৌকায় চড়ার যে পথটি আছে সেই পথে যেতে। সত্যি এই পথটি ভাল,ধন্যবাদ তুষার ভাইকে। তবে এই প্রবেশ পথটিতে যদি কর্তৃপক্ষ একটি সাইনবোর্ড যুক্ত করেন যে এখান দিয়ে হুইলচেয়ার নিয়ে প্রবেশ করা যাবে, তাহলে খুবই ভাল কাজ হবে বলে আমি মনে করি। একদিকে যখন র‌্যাম্প তৈরীর কথা বলা হচ্ছে আমাদের মুক্ত চলাচলের জন্য তখন রবীন্দ্র সরোবর শুধু একটি সাইনবোর্ড ব্যবহার করে সবাইকে জানিয়ে দিতে পারে তাদের একটি পথ আছে, আর অন্যদিকে আমার মত সমস্যাগ্রস্থরা পথটি খুঁজে পাবে খুব সহজে।


অনুষ্ঠান চারটায় শুরু, আমি মা কে সাথে নিয়ে বের হলাম সাড়ে চারটায়, এই প্রথম বলে রবীন্দ্র সরোবর খুঁজে তার প্রবেশ পথগুলো পেতে একটু দেরী হয়ে গেল। ধানমন্ডি ব্রীজের উপর যখন উঠলাম দূর থেকে জায়গাটা দেখা যাচ্ছিল, আর ভেসে আসছিল গান ‘নিথুয়া পাথারে নেমেছি বন্ধুরে.........’। ইস মিস হয়ে গেল, গানটি কাছ থেকে শোনা হলো না। মিস করেছি প্রথম দিকের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের কথাগুলো,যার মাঝে তুষার ভাইও ছিলেন।


আমার কাংখিত পথটি খুঁজে পেলাম অবশেষে, চলতে লাগলাম লেইকের পাশ দিয়ে, পথ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তখনো জানি না। মঞ্চের কাছাকাছি এসে দেখলাম অনেক মানুষ, ভীড় ঠেলে এগুতে লাগলাম সামনে, অবাক হয়ে একসময় দেখলাম পৌঁছে গেছি একদম মঞ্চের পাশে। প্রিয় লেখক আনিসুল হক তখন ভাস্কর বন্দোপাধ্যায়ের কবিতা আবৃত্তির ঘোষনা দিচ্ছেন। শুনলাম তার কবিতা, ‘নন্দলাল তো একদা একটা করিলো ভীষণ পণ.........’। যে মানুষগুলোকে শুধু টিভি পর্দাতেই দেখেছি, তাদের সামনা সামনি দেখতে পেয়ে মনে হচ্ছিল একি সত্যি না কি, স্বপ্ন দেখছি। তারাও রক্তমাংসের মানুষ জানি, তারপরও পথে ঘাটে যারা চলেন তারা নিশ্চয়ই তাঁদের দেখা পান। কিন্তু আমার জন্য ব্যপারটি বড়, কারণ এই সুযোগ আমার কোনদিন হয়নি। অনেক মানুষ ছিল মঞ্চ ঘিরে রাস্তা পর্যন্ত। অনেকের চোখেই দেখেছি বিস্ময়, একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী এসেছেন অনুষ্ঠান দেখতে, তাও আবার মেয়ে। হয়তো ভেবেছেন দিন বদলের স্লোগান তাহলে সার্থক। গতবছর যখন প্রথম আলো বদলে দাও বদলেও যাও অনুষ্ঠানটি করেছিল এইখানে, তখনও ভাবি নি, সেই প্রিয় শিল্পী শাকিলা জাফর, ফাহমিদা নবী, এস আই টুটুল তাঁদের গাওয়া ‘বদলে দাও বদলে যাও’ গানটি তাদের কন্ঠেই সামনাসামনি সেই একই মঞ্চে কোনদিন শুনতে পাবো, একই সাথে তাঁরাও দেখতে পাবেন আমাকে। আসিফ, শুভ্র দেব, মমতাজ আরো অনেক শিল্পীর পরিবেশনায় মুখর হয়ে উঠেছিল প্রাঙ্গনটি। নিরাপত্তার কথা ভেবে সন্ধ্যা নামার আগেই শেষ হলো আয়োজন।


ফেরার পথে ভাবছিলাম অনেক অপূর্ণতা রয়ে গেছে জীবন জুড়ে, ভাবছি এখন থেকে কিছুটা হলেও তা পুরণের চেষ্টা থাকবে এই দিন বদলের পালায়। যাবার চেষ্টা করবো এই ধরনের বিভিন্ন আয়োজনে। তবে একটা ব্যপার, চারিদিকে যখন প্রতিবন্ধী মানুষেরা তাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার, ভেবেছিলাম তাদের নিয়ে কিছু কথা থাকবে এই আয়োজনে। অন্তত তাদের প্রতি দৃষ্ট ভংগী পরিবর্তনের আহ্বানটুকু করা যেতে পারতো। পরের বছর এই অনুষ্ঠানে এই দেশে আমাদের মত বঞ্চিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পরিবর্তনের কথাও বলবে প্রথম আলো, সেই প্রত্যাশা রইলো।


লেখকঃ সালমা মাহবুব, ১৪ এপ্রিল, ২০১০।
salma@b-scan.org

0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment

 
Design by Oronno Anam | Bloggerized by Salma Mahbub