স্টিফেন হকিং স্বপ্ন দেখার ডাক দিয়ে যান যিনি

‘বস ঘুমোচ্ছেন’ (Boss asleep)। দরজার ওপর এমন লেখা দেখলে ভেতরে ঢোকাটা মুশকিল। কিন্তু যদি ঠিকঠাকমতো খোঁজ নিয়ে যাও, তাহলে তুমি সাহস করে ভেতরে ঢুকতে চাইবে এবং ঢুকবেও। রুমটা এলোমেলো, ছড়ানো-ছিটানো বই, একটা হোয়াইট বোর্ড! রুমের বাসিন্দাকে দেখতে তোমাকে ইতিউতি তাকাতে হবে। প্রথম দর্শনেই যদি দেখতে না পাও, তাহলে হয়তো পেছন ফিরে দরজার দিকে তাকালেই বুঝবে, তুমি ভুল ঘরে এসেছ। দরজাজোড়া মেরিলিন মনরোর এক বিরাট ছবি! নিজের ভুল বুঝে তুমি যখন বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে, তখন শুনবে একটি অদ্ভুত ধাতব কণ্ঠস্বর—স্বাগতম। তুমি ভুল করোনি!
কণ্ঠস্বর শুনে, ঠিকমতো খুঁজে টেবিলের পেছনে, হুইল চেয়ারে বসা বিজ্ঞানীকে দেখতে পাবে। মুখে এক ধরনের হাসি, ‘কী, কেমন চমকে দিলাম।’ ততক্ষণে তুমি সামনাসামনি হয়ে পড়বে এক জীবন্ত কিংবদন্তির! স্টিফেন উইলিয়াম হকিং! হকিংকে বলা হয় আইনস্টাইনের পর সবচেয়ে প্রতিভাবান বিজ্ঞানী। কতটা প্রতিভাবান? স্বীকৃতি দিয়েই শুরু করা যাক। কেমব্রিজে যেহেতু তুমি তাঁর রুমে পৌঁছেছ কাজে, নিশ্চয়ই গনভিল ও ফেবুস কলেজের স্টিফেন হকিং ভবন পার হয়েই এসেছ। এবং আসার সময় নিশ্চয়ই তাঁর মূর্তিটিও দেখেছ! দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনেও তাঁর একটি মূর্তি আছে। সান সালভাদরের বিজ্ঞান জাদুঘরটির নাম স্টিফেন হকিং বিজ্ঞান জাদুঘর।
রয়েল সায়েন্স সোসাইটি যখন নতুন ফেলো নির্বাচন করে, তখন তিনি সবার সামনে দিয়ে হেঁটে সভাপতির সামনে রাখা খাতায় সই করেন। কিন্তু ১৯৭৪ সালে হকিং যখন ফেলো হন, তখন সভাপতি ওই খাতা নিয়ে একেবারে শেষের সারিতে বসা হকিংয়ের কাছে হেঁটে আসেন। অনেক কষ্ট করে সেদিন হকিং সই করেছেন। কারণ তত দিনে মোটর নিউরন রোগে তাঁর শরীর অসার হতে শুরু হয়েছে! তাঁর পুরস্কারের তালিকা এবার দেখা যাক: এডিংটন মেডেল, হিউজেস মেডেল, তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের সর্বোচ্চ পুরস্কার আলবার্ট আইনস্টাইন মেডেল, রয়াল অ্যাসট্রোনমিক্যালা সোসাইটির স্বর্ণপদক, কপলে মেডেল—এসব পদার্থবিজ্ঞানের সব পুরস্কার তো আছেই, এই সঙ্গে আছে আমেরিকার সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম। মনে হতে পারে, তাঁকে সম্মানিত করার জন্য সবাই যেন উঠেপড়ে লেগেছে! কেন? হকিং কাজ করেন এমন একটা বিষয় নিয়ে, যা সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষকে ভাবিত করেছে—দুনিয়ার জন্ম-মৃত্যু! বিশ্বজগতের নিয়মকানুনের রাজা আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব আর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগতের খবর দেয় কোয়ান্টাম বিজ্ঞান। এই দুইকে ছাতনাতলে নিয়ে যান প্রথম এই হকিংই। রজার পেনরোজের সঙ্গে মিলে তিনি দেখালেন বিগব্যাং থেকেই এই মহাবিশ্বের (universe) শুরু! অবিশ্বাসীরা চোখ তুলে বলল, ‘সে কী, বিগব্যাংয়ের আগে তাহলে কী ছিল।’ হেসে জবাব দেন হকিং, ‘তার আগে বলো উত্তর মেরুর উত্তরে কী আছে?’

শুধু শুরুতে নয়, কোয়ান্টাম জগতের অনিশ্চয়তা নীতিকে তিনি নিয়ে গেলেন কৃষ্ণবিবরের (ব্ল্যাকহোলের) কাছে এবং আশ্চর্য হয়ে দেখলেন কৃষ্ণবিবর কালো নয়! ওর থেকে বের হয়ে আসছে কণাস্রোত! তার মানে, কণা বের হয়ে একসময় কৃষ্ণবিবরও লয় পাবে! কী ভয়ানক! তাহলে তো সবই বিকিরণ হয়ে যাবে শেষ বিচারে!
১৯৭৩ সালে হকিং যখন কৃষ্ণবিবরের কণাস্রোতের কথা বললেন, তখন অনেকেই ভ্রূ কুঁচকেছেন। এখন এই কণাস্রোতের নাম হকিং বিকিরণ! হকিং চেষ্টা করেছেন কালভ্রমণের (Time travel) একটা উপায় বের করার। দেখলেন ওয়ার্মহোল দিয়ে চলে যাওয়া যায় অতীতে কিংবা ভবিষ্যতে!
পদার্থবিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য এমন একটা তত্ত্ব বের করা, যাতে সবকিছু ব্যাখ্যা করা যায়। এমন একটি তত্ত্বের সন্ধানে এখন হকিং ব্যস্ত! কখনো স্ট্রিং থিউরি, কখনো ভিন্ন কিছু। ১৯৪২ সালে যেদিন ইংল্যান্ডে হকিংয়ের জন্ম, ঠিক এর ৩০০ বছর আগে ইতালিতে মারা যান গ্যালিলিও গ্যালিলি। ২১ বছর বয়সে হকিং আক্রান্ত হন স্নায়ুরোগে, যা এএলএস ডিজিজ নামে পরিচিত। ২০০৯ সালের দিকে এসে তিনি পুরোপুরি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেছেন। তবে, তাঁর স্বপ্ন রচনা থেমে নেই। জ্যামিতিক চিত্রের মাধ্যমে তিনি নিজের চিন্তাকে বিকশিত করেন। বর্তমান স্ত্রীর আগের স্বামীর বানানো কম্পিউটার সফটওয়্যার দিয়ে কথাও বলতে পারেন! তা নিয়ে তিনি ছুটে যান দেশ থেকে দেশে, লোকেদের শোনান বিজ্ঞানের কথা। বলেন, বিজ্ঞান আর গবেষণাকে ভালোবাসতে, যাতে মানবজাতি এগোতে পারে।
কেবল বক্তৃতা নয়, লিখে ফেলেছেন বিজ্ঞানকে সহজ করে বলা বই। এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম, ইউনিভার্স ইন এ নাটশেল, ব্রিফার হিস্টরি অব টাইম, ব্ল্যাকহোল অ্যান্ড বেবি ইউনিভার্স প্রভৃতি বই। মেয়ে লুসির কাছে সর্বশেষ লিখেছেন, জর্জ’স সিক্রেট কি টু ইউনিভার্স, যেখানে হ্যারি পটারের স্টাইলে বিজ্ঞানের জটিল বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।

হকিং অভিনয় করেছেন স্টারট্রেকের ডিসেন্ট এপিসোডে। যারা তোমরা পিঙ্ক ফ্লয়েডের ডিভিশন বেল অ্যালবামের ‘কিপ টকিং’ গানটা শুনেছ, তারা সবাই কিন্তু হকিংয়ের সিনথেসাইজড শব্দও শুনেছ! সেখানে তাঁর সিনথেসাইজড ভয়েস ব্যবহার করা হয়েছে।
হকিং যদি বিজ্ঞানী নাও হতেন, তাহলেও তিনি বিখ্যাত হতেন। কারণ ৪৫ বছর ধরে এএলএস রোগে আক্রান্ত কেউ বেঁচে আছেন, এমন কোনো রেকর্ড নেই!
তবে আমাদের সৌভাগ্য যে রোগ তাঁর চলত্শক্তি কেড়ে নিলেও তাঁর মেধা, মনন, দৃষ্টিকে কেড়ে নিতে পারেনি। সে জন্য তিনি স্বপ্ন দেখার ডাক দিয়ে যান।

প্রথম আলো
http://prothom-alo.com/detail/date/2010-04-07/news/54683

0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment

 
Design by Oronno Anam | Bloggerized by Salma Mahbub