ঠিক যেন সিনেমার পর্দায় দেখা সেই গল্প। হুইলচেয়ারে বসে জীবনের লড়াই এক ডাক্তারের। কিন্তু ‘হুইলচেয়ার’ সিনেমায় দেখা সেই গল্পের সঙ্গে তফাত একটাই। এখানে ডাক্তার এক মহিলা। যিনি চেয়েছেন, পঙ্গুত্ব জয় করে মাথা উঁচু করে বাঁচতে। তাঁর মতো অন্য মানুষদেরও দিতে চেয়েছেন সম্মানের অস্তিত্ব। তিনি শর্মিষ্ঠা সিংহ।
পাঁচ বছর আগে সেপ্টেম্বরের সেই দিনটির কথা পরিষ্কার মনে আছে তাঁর। এগারো দিন বাদে হাসপাতালের শয্যায় যখন জ্ঞান এল, তখন বুঝতে পারলেন, বুকের তলা থেকে শরীরের বাকি অংশটা অসাড়। হাসপাতালের আবাসনের ছাদে জামাকাপড় শুকোতে দিতে গিয়ে পা পিছলে তিনতলা থেকে পড়েছিলেন নীচে। প্রাণে বাঁচলেও মেরুদণ্ড দু’টুকরো হয়ে যায়। সাড়হীন হয়ে যায় নিম্নাঙ্গ। পরীক্ষায় দারুণ ফলাফল, সরকারি হাসপাতালের স্ত্রীরোগ চিকিৎসক হিসেবে নামডাক, স্বামী-মেয়েকে নিয়ে গোছানো সংসার— এক মুহূর্তে সব অর্থহীন মনে হয়েছিল শর্মিষ্ঠা সিংহের।
পাঁচ বছর বাদে সেই সরকারি চিকিৎসকই হুইলচেয়ারে ছুটে বেড়াচ্ছেন এক জেলা থেকে অন্য জেলা। খুঁজে নিচ্ছেন মেরুদণ্ডের আঘাতে পঙ্গু হয়ে যাওয়া দরিদ্র মানুষদের। তপন সিংহের ছবি ‘হুইলচেয়ার’-এর চরিত্র ডাক্তার মিত্রের মতো তিনিও প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, পঙ্গুত্ব নিয়েও আত্মনির্ভর হয়ে বেঁচে থাকার। উনচল্লিশের শর্মিষ্ঠা যাকে বলেন, ‘লাইফ উইথ ডিগনিটি’।
সরকারি অথবা বেসরকারি স্তরে এমন মানুষের পুনর্বাসন প্রকল্প নিয়ে কোনও মাথাব্যথা দেখা যায় না। তাই এ ক্ষেত্রেও ‘ডাক্তারদিদি’ নিজের উদ্যোগেই শেখাচ্ছেন, শরীরের অসাড়তা জয় করে জীবনের রং, রূপ, স্বাদ উপভোগ করে বাঁচার প্রক্রিয়া।
পুনর্বাসন পরিষেবা প্রায় নেই বলেই মেরুদণ্ডের আঘাতে পঙ্গু হওয়ার পরে চরম সঙ্কটে পড়েন রোগীরা। পড়েছিলেন শর্মিষ্ঠাও। তিনি জানান, হঠাৎ বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে নিজেকে কী ভাবে সামলাবেন, তা বুঝতেই পারছিলেন না। নতুন নতুন সমস্যা এবং তারই সঙ্গে চেপে বসা মানসিক অবসাদকে জয় করতে পারছিলেন না।
এর পরে বাইরে থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে সেই সব বাধা ধীরে ধীরে পেরিয়েছেন তিনি। কিন্তু অনেকের পক্ষেই সেই প্রশিক্ষণ পাওয়া সম্ভব নয়। একটু সুস্থ হওয়ার পরে এই ভাবনা থেকেই আর জি করে ডাক্তারি সামলে অর্ধেক অসাড় শরীরেই নতুন কাজ শুরু হয় ‘ডাক্তারদিদি’র। তাঁর নিজের কথায়, “আমি বোঝা হয়ে যাব মনে করে অনেক কাছের মানুষ আমাকে ত্যাগ করেছিলেন। তাই দেখিয়ে দিতে চাই যে, আমার মতো মানুষেরা জড়পদার্থ হয়ে নয়, আত্মসম্মান নিয়েই বাঁচতে পারেন।” ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ অর্থোপেডিক্যালি হ্যাণ্ডিক্যাপড’ এবং সব ক’টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজের নথি ঘেঁটে সম্প্রতি মেরুদণ্ডের আঘাতে পঙ্গু হয়েছেন, এমন মানুষদের নাম-ঠিকানা জোগাড় করতে শুরু করেন শর্মিষ্ঠা। ফোন করে, চিঠি লিখে যোগাযোগ শুরু হয় তাঁদের সঙ্গে। যাঁরা এঁদের মধ্যে আর্থসামাজিক দিক দিয়ে পিছিয়ে, তাঁদের সঙ্গে নিজে দেখা করেন শর্মিষ্ঠা।
কখনও এই ‘ডাক্তারদিদি’ চলে যান জেলায়, কখনও মেরুদণ্ডের আঘাতে পঙ্গু রোগীকে পরিজনেরা নিয়ে আসেন কলকাতায়। শর্মিষ্ঠা নিজেই প্রশিক্ষণ দেন তাঁদের। জেলায় কর্মরত বন্ধু-চিকিৎসকেরাও এমন মানুষের কাছে পৌঁছতে তাঁকে সাহায্য করছেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকেরাও। শর্মিষ্ঠা এমন রোগীদের নিয়ে এলে তাঁরা নিখরচায় চিকিৎসা করছেন, মানসিক কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থাও করছেন। ‘স্পাইনাল ইনজুরি অ্যাসোসিয়েশন অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’-এর প্রধান চিকিৎসক মৌলিমাধব ঘটকের কথায়, “মেরুদণ্ডে আঘাতপ্রাপ্তদের একটা বড় অংশ দরিদ্র মানুষ। কেউ গাছে উঠতে গিয়ে পড়ে যান, কেউ পথ-দুর্ঘটনায় বা বাড়ি তৈরির কাজ করতে গিয়ে উঁচু থেকে পা পিছলে পড়ে পঙ্গু হন। স্বাস্থ্য দফতরকে বারবার বলেও অস্ত্রোপচারের পরে এই রোগীদের প্রাত্যহিক দিনযাপনের উপযোগী করার ব্যবস্থা হয়নি। কারও পরোয়া না-করে একাই সে কাজটা শুরু করেছেন শর্মিষ্ঠা।”
নিজের বাড়িতে কাজে ব্যস্ত শর্মিষ্ঠা সিংহ। — নিজস্ব চিত্র |
‘গুজারিশ’ ছবিতে দুর্ঘটনায় গলার নীচ থেকে অসাড় হয়ে যাওয়ায় স্বেচ্ছামৃত্যু চেয়েছিলেন হৃতিক রোশন অভিনীত চরিত্র জাদুকর ইথান মাসকারেনহাস। শর্মিষ্ঠা কিন্তু তা চান না। হুইলচেয়ারে বসেই মেরুদণ্ড-ভাঙা মানুষগুলিকে মেরুদণ্ড সোজা করে বাঁচার কৌশল শেখাতে চান তিনি।
সুত্রঃ পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা।
সুত্রঃ পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা।
2 মন্তব্য(সমূহ):
এই বাস্তব গল্পগুলো অনেক সময় রূপকথার মতই মনে হয়। বিশ্বাস হতে চায় না, একজন মানুষের ভেতরে এত মনের শক্তি থাকতে পারে। আসলে আঘাতই মানুষকে সামনে যাবার প্রেরণা যোগায়। দুর্দম করে দেয়।
অনেক অনেক শুভকামনা রইলো ডাক্তার দিদির জন্য। তাঁর প্রচেষ্টায় আলোকিত হয়ে উঠুক আরও শত শত জীবন।
ডাক্তার দিদির জন্য শুভ কামনা। আপনারা এগিয়ে যান। স্রষ্টা অবশ্যই আপনাদেরকে সাহায্য করবেন। অনেক কিছুই বলার ছিলো। কিন্তু, কি করে বলবো? আমি যে আমার দায়িত্বটুকু পালন করিনি।
Post a Comment