২০০৪ সালে আমরা যখন মগবাজারে ভাড়া বাসায় থাকতাম তখন সিদ্ধেশ্বরীতে আমাদের এপার্টমেন্টের কাজ শুরু হয়। হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে গিয়ে আমাকে বেশ কিছু সমস্যায় পড়তে হতো, র্যাম্পের অভাবে সব জায়গায় যেতে না পারা, নিজে নিজে এক সিট থেকে অন্য সিটে, যেমন বিছানা থেকে চেয়ারে বা চেয়ার থেকে বিছানায় কারো সাহায্য ছাড়া উঠতে বা নামতে না পারা, বাথরুমের দরজা চাপা হওয়ার কারণে চেয়ারটি নিয়ে ঢুকতে না পারা ইত্যাদি। প্রতি মুহুর্তেই অনেক সাহায্য লাগতো আমার। আর সবসময় ভাবতাম ভাড়া বাসায় আমার যে প্রতিবন্ধকতাগুলো আছে তা নিজের বাড়ীতে থাকবে না। সেখানে আমি একাই টয়লেটে যেতে পারবো, কারও সাহায্য লাগবে না শুধু দরজাটি চওড়া হতে হবে আমার হুইলচেয়ারটি ঢুকবার জন্য, আর চৌকাঠটি হতে হবে নিচু, ব্যস। আরও সহজভাবে টয়লেটের সমস্যাটি সমাধান করা যায় দরজা চওড়া করার পাশাপাশি, যদি চৌকাঠ না দিয়ে ঘরের মেঝে থেকে বাথরুমের মেঝেটি এক থেকে দেড় ইঞ্চি নামিয়ে দেয়া যায়, যা ঐ সময় আমার জানা ছিল না। বাইরের দেশগুলোতে তাই করা হয়।
যাই হোক, এপার্টমেন্টে আমার রুমের সাথেই বারান্দা, যার ওপাশে বিশাল খেলার মাঠ, বারান্দাটাও বেশ বড়। ভেবেছিলাম যখন তখন চলে যাব বারান্দায়, ছেলেদের খেলা দেখবো কিংবা একটু মুক্ত হাওয়ার স্বাদ নেব অথবা মন খুব খারাপ হলে চলে যাব ছাদে খোলা বিশাল আকাশের নীচে বুক ভরে শ্বাস নিতে, কারণ সেখানে তো লিফট থাকবে। সেই সময়টায় আমার বাইরের জগতটা তখনও তৈরী হয়নি, তখন আমি ঘর থেকে বের হতাম খুবই কম, হয়তো বছরে দুইবার কি তিনবার। তাই এই সামান্য চাওয়াগুলো আমার কাছে অনেক বড় ছিল। দুঃখের বিষয় এর কোনটিই পূরণ হয় নি।
এপার্টমেন্টে আমার বাথরুমের চৌকাঠ ঘরের মেঝে থেকে ৩ ইঞ্চি উঁচু, দরজা যথেষ্ট চওড়া নয়, আমার ঘর থেকে বারান্দা যাবার পথে ৪ ইঞ্চি চৌকাঠ, যদিও স্লাডিং গ্লাস ডোর দেয়া, যার ট্র্যাকটি সাধারণত মাটির সাথে মেশানো বা ১ ইঞ্চির বেশী উঁচু হয় না। আমাদের ডেভেলপাররা কেন এমন করলেন তা তারাই ভাল জানেন, অনেক বলেও তাদের মত পালটানো গেল না। বারান্দার দেয়ালটিও তৈরী করা হলো মাটি থেকে আড়াই ফিট উচ্চতায়, তাই আমার ঘরে বসেও সেই খেলার মাঠটি দেখা যায় না, শুধু ছেলেদের হৈ চৈ এর আওয়াজ ভেসে আসে। আর ছাদ, সে তো সোনার হরিণ! আমাদের বিল্ডিংটি দশতলা আর লিফট শেষ গেছে নয়তলায় এসে। বাকি একতলা পায়ে হেঁটে উঠতে হয়, নিরাপত্তার কারণে। নিজ গৃহেও তাই নিজের চলাচলের স্বাধীনতা তৈরী হলো না, রয়ে গেলাম সেই বন্দী জীবনেই।
সব সময়ই ভাবতাম এই অসুবিধাগুলো কি করে দূর করতে পারি। বাসায় ইন্টানেট সংযোগ নেবার পর শুরু হলো নতুন জীবন, নিজে কে নিয়ে নতুন করে ভাবনা। এই দেশের কোন কিছু আমাদের জন্য তৈরী হবে না, হলেও কবে হবে তা জানা নেই, তাই যা আছে তার মাঝেই খুঁজে নিতে হবে নিজের পথ। তাই প্রথমে নিজের হুইলচেয়ারটি নতুন করে তৈরী করে নিলাম নিজের সুবিধা মত সিআরপি থেকে। নিজেদের অজ্ঞতাও অনেকটা আমাদের চলার পথকে কঠিন করে রাখে। যেমন আমি জানতাম না কি করে বাথরুমের দরজার সামনে একটি বহনযোগ্য র্যাম্প আমার এই সমস্যার সমাধান দিতে পারে। যা কাঠ দিয়ে নিজেরাও তৈরী করে নেয়া যায়। বাইরের দেশে আমাদের চলাচলের বিভিন্ন সহায়ক ব্যবস্থা দেখে উদ্যোগী হলাম সেই রকম কিছু ব্যবস্থা নিজের জন্য তৈরী করে নিতে।
লিফটের সামনের সিঁড়ি দুটি দিয়ে শুরু আমার এই যাত্রা। খুব সামান্য একটু উদ্যোগ, কিছু মানুষকে এর উপকারিতা বুঝানো, অল্প কিছু টাকা.........একটি র্যাম্প। হাঁ, আমার এপার্টমেন্টে লিফট পর্যন্ত পৌঁছুতে বা লিফট থেকে বের হয়ে ঐ সিঁড়ি দু’টো পাড় হতে হয়। মাত্র দুটো করে সিঁড়ি, একটি সম্মুখে আর একটি পাশে। পাশেরটিতে এপার্টমেন্ট নির্মানকারী প্রতিষ্ঠানটি খুব সহজেই একটি র্যাম্প সেখানে করে দিতে পারতেন কিন্তু করেন নি। এখন যেমন বলা হচ্ছে লিফট পর্যন্ত পৌছুতে র্যাম্প থাকতে হবে, ২০০৪ সালে তখন বিল্ডিং কোডে এটা ছিল কি না, জানা নেই, থাকলেও তারা সেটা মানতেন কি না সন্দেহ।
যাই হোক, সেখানে র্যাম্প তৈরীর উদ্যোগ নিলাম। সেই লক্ষ্যে আমার বিল্ডিং এর সবার মতামত নেবার জন্য এক এক করে তাদের ফ্ল্যাটে গেলাম, সাথে কিছু লিফলেট আমাদের সংগঠনের, জনকণ্ঠে ছাপা হওয়া আমার একটি লেখা ‘একজন জীবনযোদ্ধা’(একজন প্রতিবন্ধী মানুষের দৈনন্দিন জীবন চিত্র)র ফটোকপি, তাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম র্যাম্প কি জিনিস, এর উপকারিতা কি এবং এটা শুধু একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী জন্য নয়, একজন বয়স্ক মানুষ, গর্ভবতী মহিলা সবার জন্য এটা কাজে লাগবে। আমার ভাল লেগেছিল তাঁরা কেউ আমার কাজে ‘না’ বলেন নি, বরং উৎসাহ দিয়েছেন, একজন তো বললেন, একবার উনাকে হাসপাতাল থেকে হুইলচেয়ারে ফিরতে হয়েছিল, তখন কি যে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিলে হুইলচেয়ারসহ তাকে সিঁড়ি দিয়ে তুলতে, তা বলার নয়। সকলের সহায়তায় ১৫ই ডিসেম্বর আমার র্যাম্প তৈরী হলো। যাঁরা আমায় এই কাজে সহযোগীতা করেছেন আমি তাদের সকলের কাছে কৃতজ্ঞ।
এখন আমার বাথরুমের সামনেও একটি বহনযোগ্য র্যাম্প তৈরী হয়েছে মুক্ত চলাচলের উদ্দেশ্যে। তবে বারান্দায় যাওয়ার র্যাম্পটি আমি তৈরী করতে পারি নি ঘরে যথেষ্ট জায়গা না থাকায়। আমরা (যারা বাংলাদেশী সিস্টেমস চেঞ্জ এ্যাডভোকেসি নেটওয়ার্ক, বি-স্ক্যান এর সেচ্ছ্বাসেবী সংগঠনের সাথে জড়িত) মনে করি সামান্য সচেতনতা, কিছু সম্মিলিত উদ্যোগ পালটে দিতে পারে প্রতিবন্ধী মানুষের পথের প্রতিবন্ধকতা।
লেখকঃ সালমা মাহবুব, আমারব্লগ ডটকম।
7 মন্তব্য(সমূহ):
tomar cholar poth mosrin hok...
Dhonnobad Biplob,shudhu amar noy,sokol protibondhi manusher cholar poth mosrin hok. Joy Hok.
ekmot; ar kete jak amader chintar proti-bondhokota-samuha.
joy hobei! (Y)
ami mone kori amader desher proti-ta manusher agiye asha uchit nij nij obosthan theke. Bangladesh-er poribesh ekdin protibondhi manusher bash joggo hoye uthbe....joy ekdin hobei!
Ha Sabrina, amra tou setai bolchi,sommilit chotto ektu uddog palte dite pare ekjon manusher puro jibon.
একটু সচেতনতা পাল্টে দিতে পারে নানান প্রতিবন্ধকতা....ধন্যবাদ সালমা আপু, সুন্দরভাবে উপস্থাপনের জন্য।
ধন্যবাদ সুমিত,পড়ার জন্য।
Post a Comment