দৃষ্টিহীনের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে তৈরি হয়েছে নানা প্রযুক্তি। প্রযুক্তির সহায়তায় এখন অনেক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নিজেকে আলোকিত করতে সমর্থ হচ্ছেন। লিখেছেন তুহিন মাহমুদ।
প্রতিবন্ধীদের সামাজিকভাবে স্বাবলম্বী করতে বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে ব্যক্তি এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কাজ হচ্ছে। আর এরই ফলশ্রুতিতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য তৈরি হয়েছে ব্রেইল সফটওয়্যার, স্ক্রিনরিডিং সফটওয়্যার মঙ্গলদীপ, টেক্সট টু স্পিচ সফটওয়্যার সুবচন, এসএমএস রিডার প্রভৃতি।
ব্রেইল :ব্রেইল হলো অন্ধ ও যারা চোখে কম দেখে তাদের জন্য পড়ালেখার একটি মাধ্যম। ১৮২১ সালে লুই ব্রেইল নামের ফ্রান্সের একজন প্রতিবন্ধী এটি উদ্ভাবন করেন। ব্রেইলকে পরবর্তী সময় কম্পিউটারে বিভিন্ন সফটওয়্যার ব্যবহার করে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় লেখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলা ভাষায়ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল সফটওয়্যার রয়েছে।
মঙ্গলদীপ ও সুবচন :মঙ্গলদীপ হচ্ছে স্ক্রিনরিডিং সফটওয়্যার ও 'সুবচন' হলো টেক্সট টু স্পিচ সফটওয়্যার। সফটওয়্যার দুটি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক তৈরি করেছেন। মঙ্গলদীপ ইংলিশে ও সুবচন বাংলায় কাজ করতে সক্ষম। সফটওয়্যার দুটির মাধ্যমে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা বাংলা-ইংরেজি উভয় ভাষায় সহজেই কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারছেন।
বাংলা টেক্সট টু ব্রেইল ট্রান্সলেশন সিস্টেম :বাংলা ভাষায় লেখা যে কোনো ডকুমেন্টকে ব্রেইলে অনুবাদ করতে সক্ষম এই সফটওয়্যার। এফএম মাহবুব-উল-ইসলামের নেতৃত্বে ৪ উদ্ভাবক মিলে ডেভেলপ করেন সফটওয়্যারটি। মাহবুব বলেন, সাধারণ এবং অন্ধ মানুষের মাঝে শিক্ষার ব্যবধান কমাতে ব্রেইল সিস্টেমের বিকল্প নেই। সফটওয়্যারটি ব্যবহার সহজ, স্বাধীন ও ইউনিকোড সমর্থিত। এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলা ই-বুককে বাংলা ব্রেইলে অনুবাদ করতে পারে। সম্প্রতি সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের বইগুলোকে ই-বুক আকারে ইন্টারনেটে প্রকাশ করেছে। ফলে এখন থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী তার পাঠ্যবই সহজেই ইন্টারনেট থেকে পড়তে পারবে।
কথা :'কথা' হলো ইউনিকোডভিত্তিক ভাষাকে মানুষের বোধগম্য ভাষায় রূপান্তর করার প্রথম বাংলা ভাষাভিত্তিক সফটওয়্যার। একে টেক্সট টু স্পিচ সফটওয়্যার বলা হয়। সফটওয়্যারটি যে কোনো স্ক্রিনরিডার সফটওয়্যারের সঙ্গে কাজ করতে পারে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের 'সেন্টার ফর রিসার্চ অব বাংলা ল্যাংগুয়েজ প্রসেসিং' এটি তৈরি করেছে। যার নেতৃত্বে ছিলেন ফিরোজ আলম। 'কথা'র ব্যবহার একটু জটিল হলেও এটি দিয়ে ভয়েস রেসপন্স, টকিং বুক, টেলিসেন্টারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনায়াসে ব্যবহার করা যাবে।
ডাস্কবেরি বাংলা ব্রেইল সফটওয়্যার : ডাস্কবেরি হলো পৃথিবীর একটি অন্যতম জনপ্রিয় ব্রেইল সফটওয়্যার। বর্তমানে বিশ্বের ১৩০ ভাষায় এটি কাজ করতে সক্ষম। মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের বিভিন্ন সংস্করণসহ এটি অন্যান্য অফিস প্রোগ্রামগুলো থেকে ডাটা কনভার্ট করতে পারে। সফটওয়্যারটি ব্রেইলের বিভিন্ন বই, মেটেরিয়ালস, মেমো ইত্যাদি তৈরি করা সহজ। সম্প্রতি বাংলায় ব্রেইল কনভার্টার হিসেবে কাজ করছে ডাস্কবেরি। এটি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। যে কেউ ডাস্কবেরি সিস্টেমের ওয়েবসাইট থেকে এটি পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করার জন্য ডাইনলোড করতে পারবেন। তবে নিয়মিত ব্যবহার করতে কোম্পানির কাছ থেকে লাইসেন্স কিনতে হবে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই ডাস্কবেরি বাংলা ব্রেইল সফটওয়্যার হিসেবে বাজারে আসবে।
আমসি বাংলা : অ্যাডাপটিভ মাল্টিমিডিয়া সিস্টেমের সংক্ষিপ্ত রূপ হলো আমসি। এটি একটি মাল্টিমিডিয়া ওপেন সোর্স সফটওয়্যার। সাধারণত ডেইজি সংস্করণের বই পড়ার জন্য আমসি ব্যবহার করা হয়। এতে রয়েছে স্বনিয়ন্ত্রিত ভয়েসিং সিস্টেম, যার ফলে কোনো স্ক্রিন রিডার ছাড়াই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা সহজে এটি পড়তে পারবে। বর্তমানে আমসির ৩.১ সংস্করণ রয়েছে। আমসির নেভিগেশন, সাবসেকশন, পেজ, বুকমার্কসহ বিভিন্ন ফিচার প্রতিবন্ধীদের দারুণ সহায়ক। সিডি, হার্ড ড্রাইভসহ বিভিন্ন লোকেশন থেকে বই পড়ার জন্য রয়েছে ব্যবহারকারীবান্ধব সুবিধা। www.daisy.org ওয়েবসাইটটি থেকে এটি বিনামূল্যে ডাউনলোড করে ব্যবহার করা যাবে।
ব্রেইল লিখন সহায়ক যন্ত্র :ব্রেইলে ৬টি ডট রয়েছে, যে কারণে নতুন শিক্ষার্থীরা এটি ব্যবহারে বিভ্রান্তিতে পড়েন। এই বিভ্রান্তি দূর করতে উদ্ভাবন করা হয়েছে ব্রেইল লিখন সহায়ক যন্ত্র। যন্ত্রটি কম্পিউটারের সঙ্গে সংযুক্ত করে চালাতে হয়। এতে রয়েছে অডিও সিস্টেম, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে সব ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এসএমএস রিডার : দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা যাতে তাদের সেলফোনে আসা এসএমএস অনায়াসে পড়তে পারে তার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে টেক্সট টু স্পিচ এসএমএস রিডার মোবাইল সফটওয়্যার। এটি এসএমএসের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। সফটওয়্যারটি চালু করলে এটি মোবাইলে আসা এসএমএসটি তৎক্ষণাৎ পড়ে শোনাবে। এছাড়া পরবর্তী সময় শোনারও ব্যবস্থা রয়েছে। সফটওয়্যার সমর্থন করে এমন মোবাইলে এটি ব্যবহার করা সম্ভব। এসএমএসটি জোরে কিংবা ধীরে শোনার এবং ভয়েস পাল্টানোর ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে কাজ করা সংগঠন 'ইপসা' এ সফটওয়্যারটি ব্যবহার করছে।
থাক আলোয় ভুবন ভরা : দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের ভুবন আলোয় ভরে দিতে নানা প্রযুক্তি তৈরি হলেও বাংলা ভাষায় এসব প্রযুক্তি ব্যবহারে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। ডিজিটাল এক্সেসিবল ইনফরমেশন সিস্টেম ডিইসির আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষক ভাস্কর ভট্টাচার্য বলেন, বিভিন্ন দেশে প্রতিবন্ধীদের জন্য নানা সফটওয়্যার ও পণ্য তৈরি করা হলেও আমাদের দেশে এখনও তেমন বড় উদ্যোগ নেই। প্রতিবন্ধীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রযুক্তি পণ্যের দামও অপেক্ষাকৃত বেশি। যেমন বাংলা ব্রেইলের প্রিন্টারের দাম দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। ফলে ইচ্ছে থাকলেও সমস্যায় পড়েন প্রতিবন্ধীরা। সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে এসব পণ্য বাংলা ভাষায় রূপান্তরের ব্যবস্থা করলে প্রতিবন্ধীদের জন্য সহায়ক হবে।
সুত্রঃ ৭ মে ২০১১, দৈনিক সমকালঃ http://www.samakal.com.bd/details.php?news=35&view=archiev&y=2011&m=05&d=07&action=main&menu_type&option=single&news_id=154240&pub_no=684&type
0 মন্তব্য(সমূহ):
Post a Comment