শারিরীক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কিছু কাজ করতে গেলে যে কথা আমার মনে সবার আগে আসে, সেটা হল “প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু করা মানে আসলে ভগবানের সেবা করা। আমার কাছে হুইলচেয়ার মানে নারায়নের রথ, ক্রাচ মানে মহাদেবের ত্রিশূল”। বলছিলেন সৈয়দ সালাউদ্দিন পাশা, পৃথিবীজোড়া যার হাজার হাজার শিষ্যের কাছে পরিচিতি ‘গুরুজী’ নামেই, অনুষ্ঠানের আগে। পাশাজী এসেছিলেন ব্যাঙ্গালোরে, এক অনুষ্ঠানে, কিছুদিন আগে।
সীমাহীন সক্ষমতা (Ability Unlimited)
এবিলিটি আনলিমিটেড নামক সংস্থাটির জন্মের শুরু থেকে নিজের সন্তানের মত করে লালনপালন করে চলেছেন গুরুজী। ভারতনাট্টম ও কত্থকে প্রশিক্ষিত হবার পর আর পাঁচজনের মত নাচের শিক্ষক না হয়ে গুরুজী ঠিক করলেন নাচ শেখাবেন তাদের, যাদের নিয়ে আমাদের সমাজ নাচ তো দূরের কথা, তারা যে আদৌ কোন অনুষ্ঠানের যোগ্য সে কথা ভাবতে পারে না। হ্যাঁ, তিনি ঠিক করলেন, নাচ শেখাবেন শারিরীক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে।
কিন্তু এত কিছু থাকতে নাচ কেন?
নৃত্যকলা হল, আবেগ,অনুভূতি, শারিরীক ও মানসিক ভাব বিকশিত করার জন্য শ্রেষ্ঠ শিল্পমাধ্যম। জন্ম হল ১৯৮৮ সালে, যদিও রেজিস্ট্রী হতে হতে পেড়িয়ে গেছিল অনেকগুলো বছর, শেষমেষ ২০০৯ সালে সরকারী শিলমোহর লাগল। ততদিনে সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এর নাম। মূল লক্ষ থেকে কিন্তু একটুও বিচ্যুতি ঘটেনি- শারিরীক প্রতিবন্ধীদের মানসিক এবং শারিরীক বিকাশের সাথে সাথে শিক্ষা, সংস্কৃতি, কলার বিকাশ ঘটানো। একই সাথে, প্রতিবন্ধীদের সমানাধিকার, এবং সমান সু্যোগের জন্য চেষ্টা করে যাওয়া। যাতে তারা আর পাঁচজনের মত সমাজে মাথা উঁচু করে, সম্মানের সাথে, বাঁচতে পারে। এ পর্যন্ত মঞ্চস্থ বহু সফল অনুষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, রামায়ন অন হুইল, ভরতনাট্যম অন হুইল, ভগবত গীতা, সুফী অন হুইল ইত্যাদি।
কিভাবে চলে প্রশিক্ষন?
প্রত্যেক শারিরীক প্রতিবন্ধীর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে- যখন তাদেরকে প্রথম প্রশিক্ষন দিতে নিয়ে আসা হয়, দেখা হয় কি ধরনের সক্ষমতা রয়েছে তাদের। সেই অনুযায়ী তাদের চরিত্র নির্বাচন করা হয়ে থাকে। পাশাজীর ভাষায় ‘আমি যখন কাউকে প্রশিক্ষন দিতে শুরু করি, কোন প্রতিবন্ধীকে প্রতিবন্ধী হিসাবে না দেখে চেষ্টা করি তাকে একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে দেখার। এতে আমার কাজটাও অনেক সহজ হয়ে যায়; যে মূহূর্ত থেকে আমি তাদেরকে প্রতিবন্ধী হিসাবে দেখবো, তখন থেকেই বাঁধার সম্মুখীন হয়ে যাব, তাদের ভেতরের প্রতিভা বেড় করে আনাটাও কঠিন হয়ে যাবে’।
সহায়ক যন্ত্রসমূহ, যেমন ক্রাচ, হুইলচেয়ার- যে যেমন ব্যাবহার করেন চেষ্টা করা হয় মঞ্চে যেন সেটি যথোপোযুক্তভাবে ব্যাবহার করা হয়। প্রতিবন্ধীদের শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গপ্রতঙ্গকেই যেমন নাচে ব্যাবহার করা হয়, তার সহায়ক যন্ত্রটিও বাদ যায়না। তাই ক্রাচ হয়ে ওঠে তীর, ধনুক, অস্ত্র, রাজদন্ড। হুইলচেয়ার হয়ে ওঠে রাবনের পোশাক, সুফী নৃত্যের ঘাঘরা, কৃষ্ণের রথ। শেখান হয় কিভাবে নিয়ন্ত্রন করতে হবে হুইলচেয়ারকে।
প্রথম প্রথম পোষাক নির্বাচন নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছিল গুরুজীকে। হুইলচেয়ান বনবন করে ঘোরার সময় যাতে তা কোন সমস্যা না করতে পারে। তেমনই কঠিন শিল্পীদের কাছে এটা মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া, হুইলচেয়ারকে যাতে তারা নিজের পায়ের বিকল্প হিসাবে ভেবে নিতে পারে (এমনিতে হয়তো এটা আমরা সবসময়ই ভাবি, কিন্তু নাচের মুহূর্তে আরো বেশি করে দরকার)। সাধারণত হুইলচেয়ার ব্যাবহার করা হয় প্রতিবন্ধীদের চলাফেরার জন্য। ‘আমাদের প্রোডাকশন ডিপার্টমেন্টের অন্যতম প্রধান কাজ বিশেষ হুইলচেয়ার বানানো। আমি নিজে দীর্ঘদিন হুইলচেয়ার তৈরী করার কারখানায় দাঁড়িয়ে থেকে হুইলচেয়ার তৈরী করায় পরামর্শ দিয়েছি, এমনকি প্রতিবন্ধী শিশুদেরও নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছি। নাচের জন্য সম্পূর্ণ নতুন একধরনের হুইলচেয়ার তৈরী করা হয়েছে আমাদের উদ্যোগে’- জানালেন গুরুজ়ী।
পুরো প্রশিক্ষনটাই একটা শারিরীক ও মানসিক পদ্ধতি। ধৈর্্য্য, অধ্যাবসায়, নিষ্ঠা, আর কাজের প্রতি ভালবাসা হল সাফল্যের চাবিকাঠি।
সেদিন অনুষ্ঠিত হওয়া নাচের মধ্যে ছিল রামায়ন ওন হুইল। আমি কথা বলছিলাম বিভিন্ন চরিত্রের অভিনেতার সাথে।
রামঃ নরেশ। ছোটবেলায় সেরিব্রাল পালসী হয়েছিল। কিন্তু রাম তো হিন্দু পুরানে ভগবান। গত দু বছরে তার আনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন সে হাঁটতে পারে, আগের থেকে অনেক স্পষ্টভাবে কথাও বলতে পারে।
সীতাঃ শারিরীক প্রতিবন্ধী মেয়েটি নাচ-অভিনয় তো দূরে থাক, হাঁটতেও পাড়তো না। আজ ক্রাচ নিয়ে সে কলেজ থেকে ফেরার পথে রিহার্সাল দিতে আসে।
সীতাঃ শারিরীক প্রতিবন্ধী মেয়েটি নাচ-অভিনয় তো দূরে থাক, হাঁটতেও পাড়তো না। আজ ক্রাচ নিয়ে সে কলেজ থেকে ফেরার পথে রিহার্সাল দিতে আসে।
সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ালেও আজও কিন্তু প্রশিক্ষন খোলা গুরুজ়ির। খালি একটাই যোগ্যতা- হতে হবে শারিরীক প্রতিবন্ধী। বিশদ জানার জন্য দেখুন।
লেখকঃ সায়ন ঘোষ (ভারত), ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১০।
3 মন্তব্য(সমূহ):
nice
অসাধারণ উদ্দ্যেগ!!!!!!!!!
ধন্যবাদ।
Post a Comment