আমরা করব জয়...

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশ প্রতিবন্ধী নারী। এ হিসাব মতে, প্রতিবন্ধী নারীর সংখ্যা পঁচাত্তর লাখের বেশি। তাদের মধ্যে ৯৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী নারী শারীরিক বা মানসিক অথবা উভয় নির্যাতনের শিকার হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ এবং ২৮ ধারায় বাংলাদেশের সব জনগোষ্ঠীকে সমান হিসেবে দেখানো হলেও প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে পঙ্গু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ জাতীয় সব উন্নয়ন নীতি ও পরিকল্পনায় প্রতিটি প্রতিবন্ধী নারীরও রয়েছে অধিকার। তাই প্রতিবন্ধী নারীকে কৃপা, অনুকম্পা নয়; তাদের সুযোগ ও অধিকার আদায়ের পথটি করে দিতে হবে আমাদেরই। লিখেছেন রীতা ভৌমিক

আশরাফুন নাহার মিষ্টি

লাভলী খাতুন
সমন্বয়কারী, প্রতিবন্ধী নারী উন্নয়ন শাখা
বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি
 

একটি দুর্ঘটনা বদলে দিয়েছে আশরাফুন নাহার মিষ্টির জীবনধারা। ভাগ্যকে দায়ী করে থেমে থাকেননি তিনি। অত্যন্ত পরিশ্রম, নিষ্ঠার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে গেছেন জীবন নামের চাকাটিকে। তিনি জন্মগত প্রতিবন্ধী নন। তার শৈশব, কৈশোর কেটেছে অন্য স্বাভাবিক মেয়েদের মতোই দুরন্তপনার মধ্য দিয়ে। স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে সুনামও কুড়িয়েছেন। চিকিৎসক বাবা এবং সুগৃহিণী মায়ের নবম সন্তান তিনি। দশ ভাইবোনের সংসারে স্নেহ আদর ভালোবাসায় কেটেছে তার দিনগুলো। যশোরের ঝিকরগাছা থানা সদরে তাদের বাড়ি। ঝিকরগাছা পাইলট গার্লস স্কুল থেকে ১৯৯২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় স্টার মার্ক নিয়ে উপজেলায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম হন। মেয়ের এ সাফল্যে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে খুশির বন্যা বয়ে যায়। এ আনন্দ বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি তার পরিবার। বাড়ির তিনতলার ছাদ থেকে পড়ে মিষ্টির মেরুদন্ড ভেঙে যায়। ঝিকরগাছা থেকে তাকে ঢাকার মগবাজারে আরোগ্য নিকেতন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে তাকে চিকিৎসার জন্য সাভারের সিআরপিতে নেয়া হয়। দেড় বছর চিকিৎসাধীন থাকায় পড়াশোনারও প্রচুর ক্ষতি হয়। এরপরও ছয় মাস পড়াশোনা করে ঝিকরগাছায় শহীদ মশিউর রহমান ডিগ্রি কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। অনার্সে ভতি হওয়ার জন্য ঢাকা, চিটাগাং এবং কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি বিভাগে ভর্তি পরীক্ষা দেন। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্লাস দোতলা-তিনতলা হওয়ার কারণে ভর্তি হতে পারেন না।

এ প্রসঙ্গে মিষ্টি জানান, সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ক্লাস না করার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হলো না তার। ফিরে এলেন নিজের পৈতৃক ভিটায়। বিকমে ভর্তি হন শহীদ মশিউর রহমান ডিগ্রি কলেজে। এ কলেজ থেকে ১৯৯৬ সালে বিকম পাস করেন। সিএ পড়ার জন্য ঢাকায় হুদা অ্যান্ড কোম্পানিতে ভর্তি হন। কিন্তু বিভিন্ন কোম্পানিতে যাওয়া-আসা এবং যাতায়াতের সমস্যার কারণে সিএ পড়া হলো না তার। মনোবল হারালেন না। একাউন্টিংয়ে এমকমে ভর্তি হলেন মোহাম্মদপুরে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে।


এখানেও সেই পুরনো সমস্যা দেখা দিল। কীভাবে তিনি এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে এসে এমকম ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন এ সম্পর্কে মিষ্টি বলেন, অধ্যক্ষ আমাকে ডেকে বললেন, ‘আমাদের ক্লাস হয় দোতলা-তিনতলায়। এজন্য তোমাকে নিতে পারছি না।’ এবার হার মানলাম না। স্যারকে বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করলাম, আমার পরীক্ষার ফলাফলে একাউন্টিংয়ের নাম্বার সবার চেয়ে বেশি। সাতদিন আমি ক্লাস করব। তিন দিনের ক্লাসের তিনটি পরীক্ষা দেব। যদি পরীক্ষায় তিনটিতে হাইয়েস্ট নাম্বার পাই তাহলে আমাকে এখানে পড়ার সুযোগ দিতে হবে। এজন্য ক্লাস একতলায় নিতে হবে। স্যার রাজি হলেন। পরীক্ষায় হাইয়েস্ট নাম্বার পেলাম। স্যার একতলায় ক্লাস নেয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। সে সঙ্গে ঘোষণা দিলেন দারোয়ান আমাকে যেন নিচতলার সিঁড়িটা তুলে দেন। পরীক্ষার সময় দোতলা-তিনতলায় সিট পড়েছে। শিক্ষকরা হুইলচেয়ারসহ আমাকে উপরে তুলে দিয়েছেন। এভাবে শিক্ষকদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় নবম হই এবং ২০০১ সালে এমকম ফাইনাল পরীক্ষায় মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করি। এমকম পরীক্ষার পরই বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতিতে ২০০১ সালে জুলাই মাসে প্রতিবন্ধী নারী উন্নয়ন শাখার সমন্বয়কারী হিসেবে যোগদান করি। পাশাপাশি এমফিল করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। আবারো একাডেমিক সমস্যার কারণে পড়া চালিয়ে যেতে পারলাম না।
তিনি আরো বলেন, প্রতিবন্ধী বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করছি, প্রতিবন্ধী নারীদের মেধাসত্তাকে কাজে লাগানোর জন্য কাজ করছি। এজন্য বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিবন্ধী নারীদের প্রেরণা জোগাতে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি। কারণ একজন প্রতিবন্ধী নারী শারীরিক, মানসিক, দৃষ্টি, বুদ্ধি যে প্রতিবন্ধীই হোক না কেন তিনি নির্যাতনের শিকার হলে কখনো বলতে পারেন না। তাদের অধিকার আদায় করার জন্য, সহযোগিতার জন্য আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য দরকার শিক্ষার। জার্মানিতে এক বছরের স্কলারশিপ নিয়ে ‘ডিজঅ্যাবিলিটি ওয়েলফেয়ার এক্সবসিবিলিটি পিয়ার কাউন্সিলিংয়ের ওপর গ্র্যাজুয়েশন কোর্স করি। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, কানাডা, ভারত ইত্যাদি দেশে প্রতিবন্ধী বিষয়ক সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে অংশ নিই। এখানে প্রতিবন্ধী নারীরই শুধু নয়, সব পেশাজীবী মানুষেরই প্রত্যক্ষ সহযোগিতা থাকতে হবে।’


লাভলী খাতুন

লাভলী খাতুন জন্মগতভাবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। চোখে না দেখলেও থেমে থাকেনি তার পড়াশোনা। স্বাভাবিক মানুষের মতো তিনিও বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতিতে জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট কো-অর্ডিনেটর হিসেবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। এ পর্যায়ে আসতে তাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে।

লাভলীর জন্ম ১৯৮৬ সালে বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার বিহার পশ্চিমপাড়া গ্রামে। পাঁচ বোন চার ভাইয়ের মধ্যে লাভলী ষষ্ঠ। নয় ভাইবোনের মধ্যে ওরা তিন বোনই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। ছয় মাস বয়সে ওর বাবা-মা বুঝতে পারেন তাদের এ মেয়েটিও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। ওর বয়স যখন তিন এবং সেজ বোনের পাঁচ তখন বগুড়ায় চক্ষু শিবিরের ক্যাম্পিং হয়। সেখানে দিনাজপুরের একজন চক্ষুবিশেষজ্ঞ আসেন। তিনি ওদের দুই বোনের চোখ পরীক্ষা করে জানান, ওদের চোখের সমস্যা নয়, অপটিক্যাল নার্ভের সমস্যা। চোখের সমস্যা না থাকায় ওদের চোখ পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। নার্ভগুলো সতেজ হলেই ওরা দেখতে পারবে।
লাভলী জানান, সে সময় বগুড়ার শেরপুরে এবিসি নামে একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। এ প্রতিষ্ঠান দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করত। শেরপুর শাখা অফিস জরিপ করে তাদের খুঁজে বের করে। সেখানে তারা দুই বোন ১৯৯১ সালে ১ মাস ১০ দিনব্যাপী একটি মোবিলিটি প্রশিক্ষণ নেন। এ প্রশিক্ষণের মাধমে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের স্বাভাবিক চলাফেরা, দৈনন্দিন কাজকর্ম ইত্যাদি বিষয় শেখানো হতো। এ প্রশিক্ষণ চলাকালে এবিসির একটি নতুন কার্যক্রম শুরু হয়। মেয়েদের শিক্ষার জন্য একটি গার্লস হোস্টেল প্রতিষ্ঠা করে। কারা সেই স্কুলে পড়তে আগ্রহী জিজ্ঞেস করতেই তিনি তার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ওই বছরই জুলাই মাসে এবিসি ১০ জন ছাত্রী নিয়ে এর যাত্রা শুরু করে। প্রথম শ্রেণীতে জয়দেবপুর জকি স্মৃতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট ব্রেইল পদ্ধতিতে সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থায় তাদের শিক্ষা দিতেন। স্কুলের শিক্ষকরা ব্রেইল পদ্ধতি না বোঝার কারণে হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট তাদের পরীক্ষার খাতাগুলো দেখতেন। ফলে ভালো ফল করার পরও স্কুলের শিক্ষকরা তাদের ২০ জন শিক্ষার্থীর পর মেধা তালিকায় স্থান দিতেন। ষষ্ঠ শ্রেণীতে জয়দেবপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এ স্কুল থেকে ২০০১ সালে এসএসসি পাস করেন। কলেজে পড়ার আগ্রহ জানিয়ে এবিসির কাছে আবেদন করেন। আবেদন মঞ্জুর হলে গাজীপুরে কাজী আজিমুদ্দীন কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হন। এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় তার চেয়ে দুই বছরের জুনিয়র শিক্ষার্থী তার শ্রুতিলেখক হয়। ভালো শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের শ্রুতিলেখক হতে দিতে রাজি হতেন না। ফলে যে দু’জন মেয়ে শিক্ষার্থীকে শ্রুতিলেখক হওয়ার জন্য রাজি করানো হয়েছিল তাদের একজন বলে এত কষ্ট করে লিখে আপনাকে এ গ্রেড পাইয়ে দিলে আমাদের কী লাভ! বড় প্রশ্নের উত্তর এক পৃষ্ঠার বেশি লিখতে পারব না। বলতে থাকলে লেখা বন্ধ করে দেব। কোনো প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা করতে গেলে বলত পরীক্ষা দিতে আসছেন কেন? এ সমস্যার কারণে ফল আশানুরূপ হয়নি। এসব সমস্যার মধ্য দিয়ে ২০০৪ সালে এইচএসসি পাস করেন তিনি।


লাভলী আরো বলেন, এত সমস্যার পরও মনোবল হারাইনি। ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার ফর দ্য ব্লাইন্ডে যোগাযোগ দেই। মিরপুরে এ সংস্থার একটি শাখা রয়েছে। এখানে পিএবিএক্স এবং কম্পিউটার শাখায় প্রশিক্ষণের জন্য ২০০৪ সালে আবেদন করি। জুলাই থেকে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। নয় মাসের প্রশিক্ষণ নিই। আমাদের প্রশিক্ষণ দেন দুজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী প্রশিক্ষক। পিএবিএক্সে ছিলেন শিরিন আক্তার এবং কম্পিউটারে রাসেল হাসান। এখানে প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সমস্যাবিষয়ক একটি সভা করেন। সেখান থেকে ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে তারা আমাকে জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট কোঅর্ডিনেটর হিসেবে মনোনীত করেন ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। প্রশিক্ষণ শেষ হলে এপ্রিলের ৩ তারিখে কাজে যোগদান করি।



সুত্রঃ ২২ নভেম্বর, ২০১০, যায় যায় দিন।
http://www.jaijaidin.com/archive/2010-11-22/details.php?nid=218924

0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment

 
Design by Oronno Anam | Bloggerized by Salma Mahbub