''সবচেয়ে দুর্ঘম যে মানুষ আপন অন্তরালে,
তার কোন পরিমাপ নাই বাহিরের দেশে কালে।
সে অন্তরময়,
অন্তর মেশালে তবে তার অন্তরের পরিচয়।''
রবীন্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টি এই ক’টি লাইন এর মতোই যেন অন্তরদৃষ্টি স্বম্পন্ন মানুষের সাহচর্য পাবার জন্যই যাওয়া সে “সাদাছড়ি” ধারন করা মানুষদের অনুষ্ঠানে ,আমার কাছে তা’ই মনে হয়েছে শেষে। বি-স্ক্যান এর সালমা আপার ফোন পেয়ে সানন্দে রাজী হয়ে গেলাম সেখানে যাওয়ার জন্য। কিছুটা সময় আগেই পৌছলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টি,এস,সি অডিটোরিয়াম এ। “সাদাছড়ি” দিবস উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টি প্রতিবন্ধিদের সংগঠন “ বিশেষ শিক্ষার্থী সংঘ” আয়োজিত সাদা ছড়ি বিতরন অনুষ্ঠান।
অডিটোরিয়ামে ঢুকার মুহুর্তেই প্রথম অবাক করা বিষয় ,দৃষ্টি প্রতিবন্ধি আর স্বাভাবিক দৃষ্টিস্বম্পন্ন মানুষজন সবাই একসাথে কাজ করছে প্রোগ্রাম নিয়ে। আমার চারপাশটা জুড়ে সব হৃদয়ের দৃষ্টিতে পথ চলা মানুষ। প্রায় কিছুক্ষনের ভাবনা জুড়ে ছিল আমরা সবাই আসলে এক। হয়ত তার দৃষ্টি নেই,আমার আছে। কিন্তু পরক্ষনেই ভাবনাটা বেশ উদ্দিপক করে তুললো। হ্যা আমি হয়ত দেখি চোখের আলোয়,আর সে মানুষগুলো চোখের অন্ধকারকে সঙ্গি করেই ভেতরের অন্তর-আলোতে যেন উদ্ভাসিত অনেক বেশি। চারিপাশটায় আমার চোখের বিচরন ছিল অনেক বেশি। দেখছিলাম বারবার,বারবার। ওরা সবাই উদ্যমি। বেশিরভাগেরই বয়স সর্বোচ্চ একেকজন যুবক অথবা কিশোর। সবারই খুব হ্যান্ডসাম পদার্পন এবং বসে থাকা,মনে হলো যেন উনারা সবাই আসলে শুনছে না শুধু,দেখছেও প্রানভরে অনুষ্ঠানটি। যেহেতু এই মানুষগুলোর সাথে মিলাতে চাচ্ছি নিজেকে। সে সময়টায় যেন হেরেই যাচ্ছি উনাদের শারিরীক উদ্যমতায়। আহ! সে কি চমৎকার অভাবনীয় মনের শক্তি থাকলেই তা শুধু সম্ভব! তা ভেবেই স্যালুট দিতে হাতটা উঠেছিল। প্রচন্ড ইচ্ছে মেটাতেই নিজেই আড়াল করে হাতটা উঠিয়ে স্যালুটের ভঙ্গি করা সে সময়।
অবহেলা পেতে হয় আমাদেরও অনেক ক্ষেত্রে। কিন্তু এই সব অসাধারন মনের দৃষ্টির কিছু মানূষ যেন পৃথীবিই জয় করছে প্রতিনিয়ত। মনে হয়েছে আমার কাছে- উনারা শুদ্ধ! অসম্ভব মায়াময় একেকজনের চেহারা। কারও কারও হয়ত একটু মুখাবয়ব টা সুন্দর ভয়ঙ্কর। যা আসলে কাউকে ভয় জোগায় না,ভালবাসাই সৃষ্টি করে যেন। কেউ কেউ তার বর্তমান বাহ্যিক দেখতেই পান নাই কোনদিন। দেখলাম উনারাই বেশি আত্ববিশ্বাসি এবং স্মার্ট চলাফেরায় মাঝে মাঝে তাদের কারও কারও সাথে একজন থাকেন শুধু সাবধান করে দেবার জন্য পথটা।
উপস্থাপক একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। ছিলেন প্রধান অতিথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় ভিসি মহোদয়। বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় কোষাধক্ষ্য এবং দি নিউ এজ এর সম্পাদক। বক্তৃতার পালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাষ্টার্স করা একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি সাবেক ছাত্রের বক্তৃতা ছিল সবচেয়ে উদ্দিপক এবং আশাব্যাঞ্জক সব দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের। তা শুনে এই আমার কাছেও মনে হয়েছে-না আসলে,হয়ত এ হৃদয়ের খেলা আর অন্তদৃষ্টির উৎকৃষ্টতার জীবনমান দেখাই হয়ত মিস করতাম। ছবি তুলতে গিয়ে রেডি না বলেই ভাবলেশহীন মুখগুলোরই প্রতিচ্ছবি পেলাম ক্যামেরার ফ্রেমটায়।
মাঝে মাঝে নিস্তব্ধতায়ও দারুন সঙ্গিনির্ভর মনে হয়। সেরকমই অনুভুতির ছোয়া পৌছে গিয়েছে অন্তরটায়। কি যে একেকজন অসাধারন মনের দৃষ্টির অধিকারি,যারা হয়ত কোণ পৃথিবীর ছবিই দেখেনি,তাদের মধ্যেও অনেক বেশি চেতনা অনেকের চেয়েও বেশি এ পৃথিবীর। সত্যিই চমৎকার সব দৃঢ় মানসিকতার মানুষদের মিলনমেলার মধ্যেই যেন ছিলাম সারাক্ষন।
গান শুনলাম,আবৃত্তি শুনলাম,তাদের আনন্দধনি হৃদয়ে গেথে উপভোগ করলাম প্রতিটি মুহুর্তে। সবাই সেখানে আত্ববিশ্বাসি। একজনের কথা খুব গেথেই থাকবে আজীবন- আমাদেরকে অন্ধ বলবেন না,এতে আমাদের মানসিক আঘাত লাগে।দৃষ্টি প্রতিবন্ধি বললেই খুব ভাল লাগে আমাদের। অনুরোধ দৃষ্টি প্রতিবন্ধি বলেই আমাদের সবজায়গায় সম্ভোধন করবেন আশা করি।
সবই তো আছে তার সাথে আত্বসন্মানবোধও প্রচন্ড! মনে রাখবো ইনশাল্লাহ!
তাহলে কি আমাদের চেয়েও তারা উৎকৃষ্ট? উত্তর তো জানাই ,আমরা খারাপ দৃশ্যপট দেখে ভাল-খারাপ এর মধ্যেই বিচরন করি। আর উনারা মনের দৃষ্টিতে শুধু ভালটা অনুভব করেন।
এ উৎকৃষ্ট মানুষদের মনের আলো যেন স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ুক আমাদের মতো দৃষ্টিসম্পন্নদের চোখের দরজায়। তাহলেই তো হতো পৃথিবীটা আসলেই অসম্ভব এক শান্তির আবাস।
অডিটোরিয়াম থেকে বের হওয়ার সময় শুধু মনের ভেতর তাদের সে অন্তদৃষ্টির যে গুন আর শক্তি ভেতরে নেয়ার অভিপ্রায়ে ছিলাম আর ভাবনায় ছিল- আমাদের মধ্যেও যেন সে বিশুদ্ধ মনের জোড় যেন থাকে সবসময়।
সালাম তোমাদের,“সাদাছড়ি” ধারন করা সে সব অসাধারন মনের দৃষ্টির একেকজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি মানুষদের।
এগিয়ে যাও তোমরা তোমাদের মনের দৃষ্টির জোর দিয়ে সব জায়গায়,সবখানে। শুভ কামনা।
লেখক- ভালবাসার দেয়াল, ১৭/১০/২০১০
http://www.prothom-aloblog.com/posts/7/111665/
0 মন্তব্য(সমূহ):
Post a Comment