মানুষ বিধাতার সৃষ্টির সেরা জীব। তাই যুগে যুগে কিছু মানুষ জন্মগ্রহণ করেন যাদের দেখে খুবই বিস্মিত হতে হয়। চোখ দিয়ে সুন্দর পৃথিবী দেখেনি, কান দিয়ে শোনেনি কোনো বাক্য, পারেনি মুখ দিয়ে কথা বলতে। এই জগত্ তাদের কাছে অদৃশ্য, মানুষের কথা তাদের কাছে নিঃশব্দ, বাক্যহীন, নীরব, নিস্তব্ধ। পৃথিবীতে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা অতি নগণ্য। উনিশ শতকের দিকে এরকমের একজন নারী হচ্ছেন ‘হেলেন কেলার’। গত ১ জুলাই ছিল তার ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী। বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা নিয়ে ১৮৮০ সালের ২৭ জুন উত্তর আমেরিকার টুস্কুমরিয়া নামের ছোট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আথার কেলার এবং মা’র নাম ক্যাথরিন। হেলেন কেলারের বয়স যখন মাত্র দেড় বছর তখন তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাবা-মা প্রাণের প্রিয় কন্যার জীবনের আশা-ভরসা ছেড়ে দিলেও ভেঙে পড়েননি। চিকিত্সা শুরু করেন। তত্কালীন সময়ে আমেরিকা পৃথিবীর একটি উন্নত দেশ হলেও আজকের মতো চ্যালেঞ্জিং চিকিত্সা ব্যবস্থা ছিল না। বহু চিকিত্সার পর জীবন রক্ষা পায়। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! কথা বলা, শোনা এবং দেখার শক্তি চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়। অন্ধকার, আলোহীন আর নিস্তব্ধে ছেয়ে যায় মায়ার জীবন ও জগত্।
ফলে শিশুকালেই হেলেন কেলার একাধারে বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়ে বহুমুখী প্রতিবন্ধিতা নিয়েই বড় হতে থাকে। তার বয়স যখন মাত্র ৬ বছর তখন বাবা-মা তাকে ওয়াশিংটনের এক প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানী, টেলিফোন আবিষ্কারক ড. আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের কাছে পরামর্শ গ্রহণের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। কারণ আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল দীর্ঘদিন ধরে বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নের লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করছিলেন। তিনি হেলেন কেলারকে প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেন, হেলেন আর কোনোদিন চোখে দেখতে পারবে না এবং কানেও শুনতে পাবে না। তবুও হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কারণ হেলেন কেলারের বুদ্ধিমত্তা তীক্ষষ্ট। সেজন্য গুরুত্বের সঙ্গে পরিকল্পনা অনুযায়ী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে স্বাভাবিক জীবনের কাছাকাছি একটি সুন্দর জীবন ফিরে পেতে পারে।
পরিবারের উত্কণ্ঠা ও হতাশা কিছুটা হলেও কমে যায়। এরপর শুরু হয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। মাত্র ৮ বছর বয়সেই হেলেন কেলার হাতে আঙুল দিয়ে দাগ কেটে কেটে লেখা, ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখাপড়াসহ শব্দ ও বাক্য উচ্চারণ পর্যন্ত শিখে ফেলে। এতে পরিবারের লোকজন ও আত্মীয়স্বজন অবাক হয়ে যান। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় ছিল তার কথা শেখা। চোখে না দেখা ও কানে না শোনার দরুন প্রথমে একটি শব্দ ব্রেইলের মাধ্যমে জানত। শিক্ষকের মুখের কম্পন, ঠোঁট ও জিহ্বার নড়াচড়া হাত দিয়ে অনুভব করে তা বোঝা ও অনুসরণ করার চেষ্টা করত। প্রথম প্রথম যেসব শব্দ বলত তা অদ্ভুত ধরনের বিকট শব্দের মতো উচ্চারিত হতো। তবুও নিরলস সাধনা করে অসাধ্যকে সাধন করেছে, অসম্ভবকে সম্ভব করেছে।
১৪ বছর বয়সে হেলেন আমেরিকার নিউইয়র্কের ‘রাইট হুমাসন’ নামক একটি স্কুলে ভর্তি হন। এখানে বিশ্ববিখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েনের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। স্কুল ফাইনাল পাস করার আগেই তার পিতা দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেন। ১৯০৪ সালে হেলেন র্যাডক্লিফ কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেন।
যদিও তিনি সম্পূর্ণ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছিলেন, কিন্তু তিনি দৃষ্টিসম্পন্ন বহু জ্ঞানী লোকের চেয়েও বেশি বই পড়েছেন। শুধু বই পড়েনইনি, বই লিখেছেনও। তার রচিত বইয়ের সংখ্যা ১১। প্রধান বই হচ্ছে—দি স্টোরি অব মাই লাইফ, লেট আস হ্যাভ কেইথ, দি ওয়ার্ল্ড আই লিভ ইন, ওপেন ডোর ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অভিশপ্ত বিড়ম্বনা জীবনের বিষাদের ওপর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। চলচ্চিত্রে তার নিজের ভূমিকায় তিনি নিজেই অভিনয় করেছেন। তিনি বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারী ছিলেন অথচ স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে বেশি সঙ্গীত উপভোগ করতে পারতেন। তার সঙ্গীত উপভোগ করার আশ্চর্য পদ্ধতি ছিল। তিনি বাদ্যযন্ত্রের ওপর হাত রেখেই বলে দিতে পারতেন তাতে কি ধরনের সুর বাজছে। হাতের স্পর্শ দিয়ে তিনি শ্রবণের কাজ করতেন আশ্চর্য বুদ্ধিমত্তা দ্বারা। গায়ক-গায়িকার কণ্ঠে হাত দিয়ে অনায়াসে বলতে পারতেন কি সঙ্গীত গাইছে। তার এমন আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল যে, বহুদিনের পরিচিত মানুষের সঙ্গে করমর্দন করে বলে দিতে পারতেন তার পরিচয়। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়ে তিনি নৌকা চালাতে পারতেন। নদীতে সাঁতার কাটতে পারতেন, নৌকা বাইতে পারতেন, দাবা ও তাস খেলতে পারতেন। ঘরে বসে সেলাই করতে পারতেন।
১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের অনুরোধে হেলেন কেলার বিভিন্ন হাসপাতালে যুদ্ধাহত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নাবিক ও সৈনিকদের দেখতে যেতেন এবং শান্তি ও আশার বাণী শোনাতেন। যুদ্ধ শেষ হলে বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিশ্বব্যাপী এক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস পান। ১৯৫৯ সালে হেলেন কেলার জাতিসংঘ কর্তৃক বিশেষ সম্মানে ভূষিত হন।
১৯৬৮ সালের ১ জুন হৃদয়ের আলোতে আলোকিত এই মহিয়সী প্রতিবন্ধী নারী দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চলে যান। বিশ্বব্যাপী বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারীর স্মৃতিকে চির অম্লান করে রাখার জন্য এবং অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৭ সালে ‘আমেরিকান এসোসিয়েশন ফর দি ওভারসিজ ব্লাইন্ড’ গঠন করা হয়েছে। পরে নাম পরিবর্তন করে ‘হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল’ করা হয়েছে।
আজমাল হোসেন মামুন, বৃহস্পতিবার ১৩ মে ২০১০, আমারদেশ।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/05/13/31604
ফলে শিশুকালেই হেলেন কেলার একাধারে বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়ে বহুমুখী প্রতিবন্ধিতা নিয়েই বড় হতে থাকে। তার বয়স যখন মাত্র ৬ বছর তখন বাবা-মা তাকে ওয়াশিংটনের এক প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানী, টেলিফোন আবিষ্কারক ড. আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের কাছে পরামর্শ গ্রহণের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। কারণ আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল দীর্ঘদিন ধরে বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নের লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করছিলেন। তিনি হেলেন কেলারকে প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেন, হেলেন আর কোনোদিন চোখে দেখতে পারবে না এবং কানেও শুনতে পাবে না। তবুও হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কারণ হেলেন কেলারের বুদ্ধিমত্তা তীক্ষষ্ট। সেজন্য গুরুত্বের সঙ্গে পরিকল্পনা অনুযায়ী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে স্বাভাবিক জীবনের কাছাকাছি একটি সুন্দর জীবন ফিরে পেতে পারে।
পরিবারের উত্কণ্ঠা ও হতাশা কিছুটা হলেও কমে যায়। এরপর শুরু হয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। মাত্র ৮ বছর বয়সেই হেলেন কেলার হাতে আঙুল দিয়ে দাগ কেটে কেটে লেখা, ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখাপড়াসহ শব্দ ও বাক্য উচ্চারণ পর্যন্ত শিখে ফেলে। এতে পরিবারের লোকজন ও আত্মীয়স্বজন অবাক হয়ে যান। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় ছিল তার কথা শেখা। চোখে না দেখা ও কানে না শোনার দরুন প্রথমে একটি শব্দ ব্রেইলের মাধ্যমে জানত। শিক্ষকের মুখের কম্পন, ঠোঁট ও জিহ্বার নড়াচড়া হাত দিয়ে অনুভব করে তা বোঝা ও অনুসরণ করার চেষ্টা করত। প্রথম প্রথম যেসব শব্দ বলত তা অদ্ভুত ধরনের বিকট শব্দের মতো উচ্চারিত হতো। তবুও নিরলস সাধনা করে অসাধ্যকে সাধন করেছে, অসম্ভবকে সম্ভব করেছে।
১৪ বছর বয়সে হেলেন আমেরিকার নিউইয়র্কের ‘রাইট হুমাসন’ নামক একটি স্কুলে ভর্তি হন। এখানে বিশ্ববিখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েনের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। স্কুল ফাইনাল পাস করার আগেই তার পিতা দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেন। ১৯০৪ সালে হেলেন র্যাডক্লিফ কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেন।
যদিও তিনি সম্পূর্ণ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছিলেন, কিন্তু তিনি দৃষ্টিসম্পন্ন বহু জ্ঞানী লোকের চেয়েও বেশি বই পড়েছেন। শুধু বই পড়েনইনি, বই লিখেছেনও। তার রচিত বইয়ের সংখ্যা ১১। প্রধান বই হচ্ছে—দি স্টোরি অব মাই লাইফ, লেট আস হ্যাভ কেইথ, দি ওয়ার্ল্ড আই লিভ ইন, ওপেন ডোর ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অভিশপ্ত বিড়ম্বনা জীবনের বিষাদের ওপর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। চলচ্চিত্রে তার নিজের ভূমিকায় তিনি নিজেই অভিনয় করেছেন। তিনি বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারী ছিলেন অথচ স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে বেশি সঙ্গীত উপভোগ করতে পারতেন। তার সঙ্গীত উপভোগ করার আশ্চর্য পদ্ধতি ছিল। তিনি বাদ্যযন্ত্রের ওপর হাত রেখেই বলে দিতে পারতেন তাতে কি ধরনের সুর বাজছে। হাতের স্পর্শ দিয়ে তিনি শ্রবণের কাজ করতেন আশ্চর্য বুদ্ধিমত্তা দ্বারা। গায়ক-গায়িকার কণ্ঠে হাত দিয়ে অনায়াসে বলতে পারতেন কি সঙ্গীত গাইছে। তার এমন আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল যে, বহুদিনের পরিচিত মানুষের সঙ্গে করমর্দন করে বলে দিতে পারতেন তার পরিচয়। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়ে তিনি নৌকা চালাতে পারতেন। নদীতে সাঁতার কাটতে পারতেন, নৌকা বাইতে পারতেন, দাবা ও তাস খেলতে পারতেন। ঘরে বসে সেলাই করতে পারতেন।
১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের অনুরোধে হেলেন কেলার বিভিন্ন হাসপাতালে যুদ্ধাহত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নাবিক ও সৈনিকদের দেখতে যেতেন এবং শান্তি ও আশার বাণী শোনাতেন। যুদ্ধ শেষ হলে বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিশ্বব্যাপী এক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস পান। ১৯৫৯ সালে হেলেন কেলার জাতিসংঘ কর্তৃক বিশেষ সম্মানে ভূষিত হন।
১৯৬৮ সালের ১ জুন হৃদয়ের আলোতে আলোকিত এই মহিয়সী প্রতিবন্ধী নারী দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চলে যান। বিশ্বব্যাপী বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারীর স্মৃতিকে চির অম্লান করে রাখার জন্য এবং অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৭ সালে ‘আমেরিকান এসোসিয়েশন ফর দি ওভারসিজ ব্লাইন্ড’ গঠন করা হয়েছে। পরে নাম পরিবর্তন করে ‘হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল’ করা হয়েছে।
আজমাল হোসেন মামুন, বৃহস্পতিবার ১৩ মে ২০১০, আমারদেশ।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/05/13/31604
0 মন্তব্য(সমূহ):
Post a Comment