কত কিছুই না ঘটে মানুষের জীবনে!
জীবনের নানা ঘটনা গল্পের চেয়েও বিস্ময়কর হতে পারে।
কোনো কোনো ঘটনা মনকে আনন্দে ভরে দেয়। কোনো কোনো ঘটনা পৌঁছে দেয় বিষণ্নতার ঠিকানায়।
এই তো, গতকালই প্রথম আলোর ‘ঢাকায় থাকি’ ক্রোড়পত্রে গোলাম কিবরিয়ার কথা ছাপা হয়েছে। মানুষের জীবনসংগ্রামের নানা কাহিনি ছাপা হয় প্রথম আলোয়। এরই ধারাবাহিকতায় গোলাম কিবরিয়াও উঠে এসেছিলেন পত্রিকার পাতায়। একজন খেটে খাওয়া মানুষের অসাধারণ জীবনকাহিনি তুলে আনাই ছিল আমাদের লক্ষ্য। ঢাকার পাঠক সেই কাহিনি পড়েছেন। কিন্তু আজ যখন প্রায় একই কথা জানাতে চাইছি সারা দেশের পাঠককে, তখন আগেই বলে রাখি, এ ধরনের ঘটনার কথা লিখতে ইচ্ছে করে না। কষ্ট হয়। তার পরও লিখতে হয়।
গোলাম কিবরিয়া এসেছিলেন নিজের কথা বলতে। শুধু বলেই ক্ষান্ত হলেন না, হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন রাস্তায়, চাক্ষুষ দেখালেন কী করে জীবন চলে তাঁর।
খুব খারাপ কাটছিল না তাঁর জীবন। কিন্তু যে কারখানায় কাজ করতেন, সেখানেই ঘটে এক দুর্ঘটনা। রোলিং মিলে তাঁর একটি হাত কাটা পড়ে। একজন কর্মঠ মানুষ মুহূর্তে পরিণত হন বেকার মানুষে। মালিক বললেন, ‘তোর হাত নাই, তুই এখানে থাইকা কী করবি, অন্য কোথাও কাম দেখ।’
পৃথিবীটা এ রকম নিষ্ঠুর হয়, তা জানা ছিল না গোলাম কিবরিয়ার। কারখানার মালিক কোনো ক্ষতিপূরণও দিলেন না। হাতটা পঙ্গু হওয়ার পর কী করবেন, তা নিয়ে অনেক ভেবেছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত বেছে নিয়েছেন পত্রিকার হকারি। সবাই জানেন, একজন হকারের আয় কত হতে পারে। সংসার তো চালাতে হবে, কিন্তু কী করে বাড়িতে বলবেন তিনি হকারি করেন?
শুধু হকারি করা নয়, কোনো দিন পত্রিকা কম বিক্রি হলে মানুষের কাছে হাতও পাততে হয়। কিন্তু সে কথা তো বলা যায় না বাড়িতে। তাঁর মুক্তিযোদ্ধা বাবা, আত্মসম্মানজ্ঞানসম্পন্ন মানুষটিকে সে কথা বলার সাহস হয়নি গোলাম কিবরিয়ার। স্ত্রী-সন্তানদেরও জানাননি সে কথা। ওরা শুনলে কষ্ট পাবে। তাই এক ধরনের অদ্ভুত লুকোচুরি খেলা শুরু করলেন তিনি। প্রতিদিনই এই লুকোচুরি খেলতে হয়। কিন্তু বাবা ও স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে এই লুকোচুরি খেলতে ভালো লাগে না তাঁর। তার ওপর রয়েছে ভয়। এই বুঝি ধরা পড়ে যেতে হয়। রাস্তায় কেউ যদি তাঁকে দেখে বাড়িতে বলে দেয়! ভিক্ষা করতে ইচ্ছে হয় না তাঁর। কিন্তু বাড়ির মানুষকে অভুক্ত দেখার চেয়ে ভিক্ষা করা ভালো—একেই নিয়তি বলে ধরে নিয়েছেন তিনি।
এই ছিল গোলাম কিবরিয়ার জীবনের কাহিনি কিংবা বলা যায় সংগ্রামের কাহিনি।
এ কথাগুলোই একটু অন্যভাবে ছাপা হয়েছিল গতকালের ‘ঢাকায় থাকি’তে।
শিরোনাম ছিল ‘লোকটা আর ভিক্ষা করতে চান না’।
ছাপা হওয়ার পর প্রথম আলো অফিসে ফোনের পর ফোন আসতে থাকে। গোলাম কিবরিয়ার জীবনসংগ্রাম ঢাকার পাঠকদের যে কী পরিমাণ নাড়া দিয়েছে, তা বোঝা যায় তাঁদের এই অবিশ্রান্ত উৎসাহ দেখে। আমরাও খুশি হই। মুক্তিযোদ্ধা বাবার এই অসহায় সন্তানটির দিকে বুঝি এবার ভাগ্যদেবী মুখ তুলে চাইলেন। তাঁর যে মোবাইল ফোনের নম্বর ছিল, তা আমরা মহা উৎসাহে দিতে লাগলাম পাঠককে। কিন্তু কেউ সেই নম্বরে ফোন করে গোলাম কিবরিয়াকে পাচ্ছিলেন না।
কেন গোলাম কিবরিয়া ফোন ধরছেন না, তা জানা গেল তাঁর চোখের পানিতে। প্রথম আলোর কার্যালয়ে এসে হু হু করে কাঁদছেন গোলাম কিবরিয়া। আমরা যখন তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি, তখনো তাঁর মোবাইল ফোন ছিল, পরার যোগ্য দু-একটা জামাকাপড় ছিল। কিন্তু গত ২৯ নভেম্বর এই মানুষটির বাড়িতে চোর ঢুকেছিল। বাড়ির বেড়া কেটে হয়েছে ওই চুরি। মোবাইল ফোন দূরে থাক, পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছুই এখন অবশিষ্ট নেই তাঁর।
গোলাম কিবরিয়াকে একটি মোবাইল ফোন কেনার টাকা জোগাড় করে দেওয়া হয়েছে। তিনি একটি সিমও উঠিয়েছেন। ৫ ডিসেম্বর যাঁরা গোলাম কিবরিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন, তাঁদের বলছি, যদি গোলাম কিবরিয়াকে সাহায্য করার ইচ্ছে থাকে আপনাদের, তাহলে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করুন ০১৯২৫১৫২৯৯৬ নম্বরে। আপনার সহমর্মিতা গোলাম কিবরিয়ার চোখের পানি মুছে দিতে পারে।
সুত্রঃ কাওছার শাকিল তারিখ: ০৬-১২-২০১০, প্রথম আলো।
http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-12-06/news/113698
জীবনের নানা ঘটনা গল্পের চেয়েও বিস্ময়কর হতে পারে।
কোনো কোনো ঘটনা মনকে আনন্দে ভরে দেয়। কোনো কোনো ঘটনা পৌঁছে দেয় বিষণ্নতার ঠিকানায়।
এই তো, গতকালই প্রথম আলোর ‘ঢাকায় থাকি’ ক্রোড়পত্রে গোলাম কিবরিয়ার কথা ছাপা হয়েছে। মানুষের জীবনসংগ্রামের নানা কাহিনি ছাপা হয় প্রথম আলোয়। এরই ধারাবাহিকতায় গোলাম কিবরিয়াও উঠে এসেছিলেন পত্রিকার পাতায়। একজন খেটে খাওয়া মানুষের অসাধারণ জীবনকাহিনি তুলে আনাই ছিল আমাদের লক্ষ্য। ঢাকার পাঠক সেই কাহিনি পড়েছেন। কিন্তু আজ যখন প্রায় একই কথা জানাতে চাইছি সারা দেশের পাঠককে, তখন আগেই বলে রাখি, এ ধরনের ঘটনার কথা লিখতে ইচ্ছে করে না। কষ্ট হয়। তার পরও লিখতে হয়।
গোলাম কিবরিয়া এসেছিলেন নিজের কথা বলতে। শুধু বলেই ক্ষান্ত হলেন না, হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন রাস্তায়, চাক্ষুষ দেখালেন কী করে জীবন চলে তাঁর।
খুব খারাপ কাটছিল না তাঁর জীবন। কিন্তু যে কারখানায় কাজ করতেন, সেখানেই ঘটে এক দুর্ঘটনা। রোলিং মিলে তাঁর একটি হাত কাটা পড়ে। একজন কর্মঠ মানুষ মুহূর্তে পরিণত হন বেকার মানুষে। মালিক বললেন, ‘তোর হাত নাই, তুই এখানে থাইকা কী করবি, অন্য কোথাও কাম দেখ।’
পৃথিবীটা এ রকম নিষ্ঠুর হয়, তা জানা ছিল না গোলাম কিবরিয়ার। কারখানার মালিক কোনো ক্ষতিপূরণও দিলেন না। হাতটা পঙ্গু হওয়ার পর কী করবেন, তা নিয়ে অনেক ভেবেছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত বেছে নিয়েছেন পত্রিকার হকারি। সবাই জানেন, একজন হকারের আয় কত হতে পারে। সংসার তো চালাতে হবে, কিন্তু কী করে বাড়িতে বলবেন তিনি হকারি করেন?
শুধু হকারি করা নয়, কোনো দিন পত্রিকা কম বিক্রি হলে মানুষের কাছে হাতও পাততে হয়। কিন্তু সে কথা তো বলা যায় না বাড়িতে। তাঁর মুক্তিযোদ্ধা বাবা, আত্মসম্মানজ্ঞানসম্পন্ন মানুষটিকে সে কথা বলার সাহস হয়নি গোলাম কিবরিয়ার। স্ত্রী-সন্তানদেরও জানাননি সে কথা। ওরা শুনলে কষ্ট পাবে। তাই এক ধরনের অদ্ভুত লুকোচুরি খেলা শুরু করলেন তিনি। প্রতিদিনই এই লুকোচুরি খেলতে হয়। কিন্তু বাবা ও স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে এই লুকোচুরি খেলতে ভালো লাগে না তাঁর। তার ওপর রয়েছে ভয়। এই বুঝি ধরা পড়ে যেতে হয়। রাস্তায় কেউ যদি তাঁকে দেখে বাড়িতে বলে দেয়! ভিক্ষা করতে ইচ্ছে হয় না তাঁর। কিন্তু বাড়ির মানুষকে অভুক্ত দেখার চেয়ে ভিক্ষা করা ভালো—একেই নিয়তি বলে ধরে নিয়েছেন তিনি।
এই ছিল গোলাম কিবরিয়ার জীবনের কাহিনি কিংবা বলা যায় সংগ্রামের কাহিনি।
এ কথাগুলোই একটু অন্যভাবে ছাপা হয়েছিল গতকালের ‘ঢাকায় থাকি’তে।
শিরোনাম ছিল ‘লোকটা আর ভিক্ষা করতে চান না’।
ছাপা হওয়ার পর প্রথম আলো অফিসে ফোনের পর ফোন আসতে থাকে। গোলাম কিবরিয়ার জীবনসংগ্রাম ঢাকার পাঠকদের যে কী পরিমাণ নাড়া দিয়েছে, তা বোঝা যায় তাঁদের এই অবিশ্রান্ত উৎসাহ দেখে। আমরাও খুশি হই। মুক্তিযোদ্ধা বাবার এই অসহায় সন্তানটির দিকে বুঝি এবার ভাগ্যদেবী মুখ তুলে চাইলেন। তাঁর যে মোবাইল ফোনের নম্বর ছিল, তা আমরা মহা উৎসাহে দিতে লাগলাম পাঠককে। কিন্তু কেউ সেই নম্বরে ফোন করে গোলাম কিবরিয়াকে পাচ্ছিলেন না।
কেন গোলাম কিবরিয়া ফোন ধরছেন না, তা জানা গেল তাঁর চোখের পানিতে। প্রথম আলোর কার্যালয়ে এসে হু হু করে কাঁদছেন গোলাম কিবরিয়া। আমরা যখন তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি, তখনো তাঁর মোবাইল ফোন ছিল, পরার যোগ্য দু-একটা জামাকাপড় ছিল। কিন্তু গত ২৯ নভেম্বর এই মানুষটির বাড়িতে চোর ঢুকেছিল। বাড়ির বেড়া কেটে হয়েছে ওই চুরি। মোবাইল ফোন দূরে থাক, পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছুই এখন অবশিষ্ট নেই তাঁর।
গোলাম কিবরিয়াকে একটি মোবাইল ফোন কেনার টাকা জোগাড় করে দেওয়া হয়েছে। তিনি একটি সিমও উঠিয়েছেন। ৫ ডিসেম্বর যাঁরা গোলাম কিবরিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন, তাঁদের বলছি, যদি গোলাম কিবরিয়াকে সাহায্য করার ইচ্ছে থাকে আপনাদের, তাহলে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করুন ০১৯২৫১৫২৯৯৬ নম্বরে। আপনার সহমর্মিতা গোলাম কিবরিয়ার চোখের পানি মুছে দিতে পারে।
সুত্রঃ কাওছার শাকিল তারিখ: ০৬-১২-২০১০, প্রথম আলো।
http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-12-06/news/113698
0 মন্তব্য(সমূহ):
Post a Comment