২ এপ্রিল বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস
মনোরোগবিদ্যা বিভাগবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
সাইফুল আর শাহানার একমাত্র ছেলে দীপ্ত (কল্পিত নাম)। বয়স প্রায় তিন। মা -বাবা হঠাৎ খেয়াল করলেন, তাঁদের ছেলেটির নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয় না। এমনকি মা-বাবা বা অন্য কারও চোখে চোখ রেখে তাকায় না। সমবয়সীদের সঙ্গে মেশে না। কোলে চড়া বা আদর করাও পছন্দ করে না। দীপ্তর বয়সী অন্য শিশুরা যেসব শব্দ উচ্চারণ করতে পারে, দীপ্ত তাও পারে না। খেলনার প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই। হঠাৎ হঠাৎ সে খেপে ওঠে, রাগ করে—তবে সে রুটিন মেনে চলতে খুবই পছন্দ করে। প্রতি রাতে সে চায় একই নিয়মে, একই জামা পরে ঘুমাতে। প্রথম দিকে সাইফুল আর শাহানা বিষয়টিকে আমলে নিলেন না। কিন্তু একপর্যায়ে অফিসের একজন সহকর্মীর পরামর্শে শিশুটিকে নিয়ে গেলেন একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে। চিকিৎসক জানালেন, দীপ্ত এমন একজন শিশু, যার অটিজম আছে। পত্রপত্রিকা আর ইন্টারনেটের কল্যাণে সাইফুল আর শাহানা মোটামুটি জানেন অটিজম কী আর এর জন্য কোথায়, কীভাবে সাহায্য পেতে হবে।
কিন্তু সাইফুল আর শাহানার মতো অটিজমে আক্রান্ত সব শিশুর মা-বাবা বিষয়টি সম্পর্কে জানেন না। তাঁরা জানেন না যে শিশুর অটিজম আছে, তার জন্য দরকার বিশেষায়িত স্কুল। এসব শিশুর মা-বাবা বেশির ভাগই পর্যায়ক্রমে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ এমনকি ঝাড়ফুঁকের আশ্রয়ও নিয়ে থাকেন শিশুর মঙ্গলের জন্য। তার ওপর অটিজম নিয়ে নানা বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা তো রয়েছেই। কী করতে পারেন এমন একজন শিশুর অভিভাবক। কেবল চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া বা বিশেষায়িত স্কুলে ভর্তি করেই শেষ নয়, করার আছে অনেক কিছু—
কোনো বিভ্রান্তি নয়: ‘অটিজম নিয়ে কোনো বিভ্রান্তিতে থাকা উচিত নয়। যদি কেউ মনে করে থাকেন যে কোনো শিশুর মধ্যে অটিজমের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে দেখতে হবে যে সত্যিই তার অটিজম আছে কি না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজ, যা চিকিৎসাবিজ্ঞানের সব রোগের পূর্ণাঙ্গ তালিকাগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত, সেখানে সুস্পষ্টভাবে শিশুর অটিজমকে একটি রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর কোড নম্বর ‘এফ ৮৪.০’। তাই ‘অটিজম কোনো রোগ নয়’ বা ‘অটিজম আছে এমন শিশুর জন্য কিছুই করার নেই’—এমন কোনো প্রচারণায় বিভ্রান্ত হওয়া চলবে না।
দায়িত্বটা দিতে হবে চিকিৎসককে: কোনো বই পড়ে, পত্রিকার স্বাস্থ্য পাতা পড়ে নিজে নিজে কোনো শিশুর অটিজম নির্ণয় করা যাবে না। কোনো শিশুর মধ্যে অটিজম আছে কি না, সেটা নির্ণয়ের দায়িত্ব দিতে হবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে।
মেনে নিতে হবে: যদি সত্যিই দেখা যায় শিশুটির মধ্যে অটিজম আছে, তবে অযথা ভেঙে না পড়ে তার রোগটিকে মেনে নিতে হবে এবং উপযুক্ত পরিচর্যার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার কথা ভাবতে হবে।
বিজ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত: অটিজম নিয়ে শিক্ষিত-অশিক্ষিত অনেকের মধ্যে নানা অবৈজ্ঞানিক ও অপবৈজ্ঞানিক ধারণা রয়েছে। কোনো মিথ্যা ধারণা দ্বারা পরিচালিত হওয়া চলবে না। মনে রাখতে হবে, কেবল বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতেই এ ধরনের শিশুর পরিচর্যায় সুফল পাওয়া সম্ভব।
পরিবারের সব সদস্যকে সাধারণ সিদ্ধান্তে আসতে হবে: দেখা যায়, অটিজম রয়েছে এমন শিশুর মা চান শিশুটিকে বিশেষায়িত স্কুলে দিতে। কিন্তু বাবা মানতেই নারাজ যে তাঁর সন্তানের কোনো সমস্যা আছে। আবার মা-বাবা হয়তো শিশুর সমস্যা মেনে নিয়ে উপযুক্ত সহায়তা নিতে রাজি হলেন, কিন্তু বেঁকে বসলেন শিশুটির দাদা বা সংসারের মুরব্বি কেউ। তিনি মিথ্যে লোকলজ্জার ভয়ে শিশুটিকে কোনো চিকিৎসকের কাছে বা বিশেষায়িত স্কুলে দিতে রাজি হলেন না। তাই শিশুটির মঙ্গলের জন্য পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে একটি ইতিবাচক সাধারণ সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
নিজেদের দায়ী করা যাবে না: অটিজমের কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেন শিশুটির এ সমস্যা হলো, তা নিয়ে নিজেদের বা একে অপরকে দায়ী করা যাবে না।
৩১ শে মার্চ,২০১০, প্রথম আলো।
http://prothom-alo.com/detail/date/2010-03-31/news/52785